এক সময় চরমপন্থি সংগঠন গণমুক্তি ফৌজের নামে অস্ত্রবাজ গ্রুপ গড়ে কুষ্টিয়া এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন জাহাঙ্গীর কবির ওরফে লিপটন। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব উল আলম হানিফের হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে মুলধারার রাজনীতিতে নাম লিখিয়ে হয়ে উঠেছিলেন এলাকার মুর্তিমান আতঙ্ক।
বহুল বিতর্কিত সাবেক র্যাব কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে ‘ক্রসফায়ার’ এর নামে ভাড়ায় মানুষ খুন, গুম ও অস্ত্র কারবারের বিশাল নেটওয়ার্কও ছিল তার। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পতনের পর আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হলে ভোল পাল্টে বিএনপির জার্সি গায়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন লিপটন। কিন্ত সে চেষ্টা ব্যর্থ করে তিন সহযোগীসহ তাকে গ্রেপ্তার করেছে সেনা বাহিনী।
শুক্রবার কুষ্টিয়া থেকে গ্রেপ্তারের পর তার কাছ থেকে বিপুল অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। এর আগে ২০১৫ সালের ফ্রেব্রুয়ারিতে কলকাতায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন লিপটন। স্থানীয় ও সেনা সুত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
যেভাবে গ্রেপ্তার লিপটন
জানা গেছে, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আত্মগোপনে চলে যান লিপটন। কিন্ত সম্প্রতি সুযোগ বুঝে কুষ্টিয়ার স্থানীয় বিএনপির নেতা জাকির সরকারের সঙ্গে সখ্য গড়ে ফের প্রকাশ্যে এসে অপরাধ জগতে সক্রিয় হন-এই অভিযোগ পেয়ে বেশ কিছু দিন ধরেই লিপটনের গতিবিধির ওপর গোয়েন্দা নজরদারি শুরু হয়। গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহকালে জাকির সরকারের সঙ্গে লিপটনের ঘনিষ্ট মুহূর্তের ভিডিও পাওয়া যায়।

বৃহস্পতিবার তার অবস্থান নিশ্চিত হয়ে আজ (শুক্রবার) ভোরে কুষ্টিয়ার সদর উপজেলার উজানপুর ইউনিয়নের দুর্বাচারা গ্রামের কয়েকটি বাড়ি ঘিরে ফেলে সেনা বাহিনীর একটি দল। সেখানে অভিযান চালিয়ে তিন সহযোগীসহ তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে ৬টি পিস্তল, একটি বন্দুক কয়েকটি ম্যাগজিন, গুলি ও দেশীয় বিভিন্ন ধরনের ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
কে এই লিপটন
৯০ এর দশকে কলেজ ছাত্রলীগের মিছিল-মিটিংয়ের মাধ্যমে রাজনীতিতে হাতেখড়ি লিপটনের। পরবর্তীতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অতিমাত্রায় সক্রিয় চরমপন্থি সংগঠন গণমুক্তিফৌজে নাম লেখান। কুষ্টিয়া শহরে প্রকাশ্যে জামাই বাবুসহ একাধিক ব্যক্তিকে হত্যা করে আলোচনায় আসেন লিপটন। এর পর তাঁর অপরাধ নেটওয়ার্ক আশপাশের জেলায় বিস্তৃত হয়।
র্যাবের একটি সুত্র জানায়, র্যাবের সাবেক গোয়েন্দা প্রধান জিয়াউল আহসানের (বর্তমানে কারাবন্দি) সোর্স হিসাবেও কাজ করতেন লিপটন। জিয়ার নির্দেশে এক সময় লিপটন ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া গেলে তার নিরাপত্তা দিতেন স্থানীয় র্যাব সদস্যরা। গ্রামের বাড়ি গেলেও সেখানে র্যাবের পাহারা থাকত। লিপটন বিগত সময়ে র্যাবের নাম ব্যবহার করে অস্ত্র ব্যবসা, চাঁদাবাজি, নিরীহ লোকজনকে অস্ত্র দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়ার মতো বহু ঘটনা ঘটালেও তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।
লিপটনের যত অপকর্ম
কয়েক বছর আগে হানিফকে তার এলাকায় ফুলের তোড়া দেওয়ার মাধ্যমে প্রকাশ্যে আসেন এই চরমপন্থি। বড় জনসভা করে হানিফকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এর পর ঢাকায় হানিফের অফিসে বেশির ভাগ সময় কাটাতেন লিপটন। এ ছাড়া হানিফের চাচাতো ভাই আতাউর রহমান আতার সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে এলাকার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি।
নিজ এলাকার নিরীহ এক ইউপি মেম্বারকে র্যাবের মাধ্যমে তুলে এনে অস্ত্র রাখার অভিযোগ দিয়ে কারাগারে পাঠানোর পর হাজার হাজার নারী-পুরুষ তাঁর বিরুদ্ধে মহাসড়ক অবরোধ করে মিছিল-সমাবেশ করেছিল। এ ছাড়া ২০১৫ সালে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন সবুজকে গাজীপুরের একটি রিসোর্ট থেকে র্যাব তুলে নিয়ে যায়। এর পর তাঁর আর কোনো খোঁজ মেলেনি।
এ ঘটনার জন্য সবুজের পরিবার হানিফকে দায়ী করে মামলা করেছে। অভিযোগ আছে, র্যাবকে দিয়ে সবুজকে অপহরণের পেছনে কলকাঠি নাড়েন লিপটন। ভয়ে লিপটনের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেনি পরিবার।
আরও জানা গেছে, কুষ্টিয়া জেলা পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ চরমপন্থি লিপটন র্যাবের সোর্স পরিচয় দিয়ে কুষ্টিয়া ও আশপাশের জেলায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। তাঁর নিজ এলাকা কুষ্টিয়া সদর উপজেলার দূর্বাচারার লোকজনও অত্যাচার-নির্যাতন থেকে রক্ষা পায়নি। আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপি-জামায়াতের লোকজনকে র্যাব দিয়ে নানাভাবে হয়রানি, অত্যাচার করা হয়েছে। জিয়াউল আহসানের শেল্টারে থাকাকালিন র্যাবের নাম ভাঙ্গিয়ে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি করেছেন। ৫ আগস্টের আগে ছাত্র-জনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে র্যাবকে দিয়ে অনেককে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে।
গ্রেপ্তারের খবরে লিপটনের কঠোর শাস্তির দাবি জানিয়েছে এলাকার মানুষ। তার বিরুদ্ধে অনেকেই এখন মুখ খুলতে শুরু করেছে। ভবানীপুর গ্রামের ধান ব্যবসায়ী রাশিদুল ইসলাম বলেন, ‘এলাকার একটি মারামারি নিয়ে মামলায় সাক্ষী হওয়ার জেরে লিপটন র্যাব দিয়ে আমাকে একটি চায়ের দোকান থেকে তুলে নিয়ে যায়। দুটি অস্ত্র দিয়ে চালান করা হয়। চার মাস পর জামিন পেয়েছিলাম। এখনও হাজিরা দিচ্ছি।’ শুধু এই ব্যবসায়ীকেই নয়, গত এক যুগে নিজ এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানের অর্ধশতাধিক মানুষকে র্যাব দিয়ে ফাঁসিয়েছেন লিপটন।