আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলায় ১৩ নম্বর আসামি হয়েও দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক (ডিসি) বনানী বিশ্বাস। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, জালিয়াতি এবং সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তদন্তাধীন। তথ্য গোপন করে সরকারি গাড়ি ঋণ সুবিধা নেয়ার বিষয়টিও এখন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তদন্তের আওতায় এসেছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলা ও বনানীর নাম : ২০২৩ সালের ১ আগস্ট ঢাকা নিউমার্কেট এলাকায় একটি আন্দোলনে আহত হন মুসফিকুর রহমান। এই ঘটনার সূত্র ধরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের হয়, যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারি প্রশাসনের একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা অভিযুক্ত হন। মামলার এজাহারে বনানী বিশ্বাসকে ১৩ নম্বর আসামি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই মামলা এখনো তদন্তাধীন থাকলেও, তিনি সরকারিভাবে তার ডিসি পদে বহাল রয়েছেন।
এই মামলাটি ২০২৪ সালের “জুলাই আন্দোলন” এবং চলমান বৈষম্যবিরোধী গণঅসন্তোষের পটভূমিতে দায়ের করা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর শাইখ মাহদী জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত প্রায় ৪০০টির বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে, যার মধ্যে ৬৫টি তদন্তাধীন রয়েছে। বনানী বিশ্বাসের সংশ্লিষ্ট মামলাটি তাদের মধ্যে অন্যতম।
৩০ লাখ টাকার গাড়ি ঋণ : তথ্য গোপন ও জালিয়াতির অভিযোগ : বনানী বিশ্বাস তার স্বামীর পুরনো গাড়ি নিজের নামে স্থানান্তর করে তথ্য গোপনপূর্বক সরকারের গাড়ি ঋণ সুবিধা গ্রহণ করেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গাড়ি সেবা শাখার দলিল অনুযায়ী, ২০১৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তিনি সরকারি ঋণে ২০১৫ মডেলের একটি ১৫০০ সিসি টয়োটা কার (নম্বর ঢাকা মেট্রো-গ-২৬-২৩৫৪) কেনেন এবং ৩০ লাখ টাকা ঋণ গ্রহণ করেন। এ চুক্তিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন উপসচিব মো: শরীফুল ইসলাম এবং বনানী বিশ্বাস যৌথভাবে স্বাক্ষর করেন।
২০১৯ সালের আয়কর নথি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বনানী বিশ্বাস ওই গাড়িটি তার স্বামী ডা: বিবেকানন্দ কির্তনীয়ার কাছ থেকে ৩১ লাখ টাকায় কিনেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। অথচ সেই একই বছরে তার স্বামী দাবি করেন, তিনি গাড়িটি ২৫ লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন। এই অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্যে প্রমাণ মেলে যে, ঋণ গ্রহণের উদ্দেশ্যে জাল দলিলপত্র তৈরি করা হয়েছে, যা সরকারি কর্মচারী আচরণবিধির চরম লঙ্ঘন।
এ ধরনের জাল তথ্য প্রদানের কারণে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-এর ধারা ৪ অনুযায়ী গুরুদণ্ড পর্যন্ত আরোপ করা যেতে পারে।
দুর্নীতি, অবৈধ সম্পদ ও সম্পদের উৎস গোপন : বনানী বিশ্বাসের বিরুদ্ধে আরো বিস্তৃত দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তিনি ময়মনসিংহ জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা থাকাকালে অবৈধ উপায়ে অর্থ ও সম্পদ অর্জন করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে ২০২৫ সালের ২২ এপ্রিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বিষয়টি বিভাগীয় কমিশনারের কাছে তদন্তের জন্য পাঠায়।
তদন্তাধীন অভিযোগে বলা হয়, বনানী বিশ্বাস বিভিন্ন সময়ে গৌরিপুর, ফুলপুর এবং ফুলবাড়ীয়া উপজেলায় এসিল্যান্ড ও ইউএনও পদে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর জেলা পরিষদের সচিব এবং পরে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে দায়িত্বে ছিলেন।
এই সময়ে তিনি ময়মনসিংহের কাশর অনন্যা প্রজেক্টে ১০ শতাংশ জমির একটি প্লট ১ কোটি ৫০ লাখ টাকায় এবং মুমিনুন্নেছা কলেজ সংলগ্ন একটি ১১ তলা ভবনের ৭ তলায় ১৮০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট ১ কোটি ৭৫ লাখ টাকায় ক্রয় করেন।
তা ছাড়া ২০১৯ সালেই তিনি ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় নিউ ঢাকা সিটি প্রকল্পে পাঁচ কাঠার একটি প্লট কেনেন এবং আশুলিয়ার প্রশাসন ক্যাডার কো-অপারেটিভ সোসাইটিতে আরো একটি জমির মালিকানা দাবি করেন।
তার স্বামী ডা: বিবেকানন্দ কির্তনীয়ার নামে ময়মনসিংহের কেসি রোড ও ঢাকার শ্যামলিতে দু’টি ফ্ল্যাট এবং একটি বেসরকারি হাসপাতালের উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ রয়েছে বলেও একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে।
প্রশাসনিক নীরবতা ও তদন্তের অগ্রগতি : নেত্রকোনার ডিসি বনানী বিশ্বাসের সাথে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি মোবাইল ফোন রিসিভ করেননি, এমনকি হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো বার্তাতেও সাড়া দেননি।
তবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ সাহেদুল ইসলাম জানান, “বনানী বিশ্বাসের বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে এসেছে এবং সেটি তদন্তের জন্য বিভাগীয় কমিশনার বরাবর পাঠানো হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন এখনও আসেনি।”
প্রশাসনের ভাবমর্যাদা প্রশ্নের মুখে : একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলা, সরকারি ঋণের জালিয়াতি এবং কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের অভিযোগ প্রশাসনের সামগ্রিক নৈতিক অবস্থানকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। মামলার তদন্তের অগ্রগতি এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থাগুলোর কার্যকারিতা এখন নিবিড় পর্যবেক্ষণের অধীন।
প্রশাসনের মধ্যে শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই অভিযোগগুলো একটি পরীক্ষার সামনে দাঁড় করিয়েছে সরকারকে। সরকারের সদিচ্ছা কতটা কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে তার নির্ভরযোগ্য পরিমাপক হতে পারে এই একটি মামলার অনুসন্ধান ও ব্যবস্থা গ্রহণ।