ইসরাইলের পরমাণু তথ্য ইরানের হাতে : ইতিহাসের অন্যতম বড় গোয়েন্দা সাফল্য দাবি তেহরানের

আরিফুল ইসলাম , প্রকাশ:08 জুন 2025, 12:39 রাত
news-banner

ইরানের গোয়েন্দা সংস্থা গোপন এক অভিযানের মাধ্যমে ইসরাইলের পরমাণু স্থাপনা ও প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা সংক্রান্ত বিপুল সংখ্যক নথি, ছবি এবং ভিডিও সংগ্রহ করেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ইরানি টেলিভিশন একে ‘ইতিহাসের অন্যতম বড় গোয়েন্দা আঘাত’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। ইরানের অন্যতম জনপ্রিয় দৈনিক হাশাহরি অনলাইন এবং দেশটির মেহর নিউজ এ খবর দিয়েছে।

খবরে বলা হয়েছে, এই গোপন অভিযানের মাধ্যমে ইরানের হাতে এসেছে ইহুদি রাষ্ট্রের পরমাণু প্রকল্প এবং অবকাঠামো সংক্রান্ত ‘হাজার হাজার গোপন নথি’। যদিও অভিযানটি কিছু দিন আগেই সম্পন্ন হয়, তবে এত বিপুল পরিমাণ তথ্য নিরাপদভাবে ইরানে পৌঁছে দেয়ার আগে পর্যন্ত গোটা বিষয়টি গোপনীয়তার পর্দায় মুড়ে রাখা হয়েছিল।

ইরানের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, এসব গোপন দলিল যথাযথ নিরাপত্তার সাথে দেশে আনা হয়েছে । পরবর্তী সময়ে সেগুলো ইরানি কর্তৃপক্ষ বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করছে।

খবরে বলা হয়, ‘ব্যাপক পরিমাণ গোপন তথ্য হাতিয়ে নেয়া ছিল এক গোপন অভিযানের ফসল।’ এসব তথ্য-উপাত্তের মধ্যে রয়েছে ‘বিপুলসংখ্যক দলিল, চিত্র এবং ভিডিও।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এত বেশি সংখ্যক নথি এবং অডিও-ভিজ্যুয়াল উপাদান পর্যালোচনায় ইরানি গোয়েন্দাদের দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে হয়েছে।

এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সামনে আসে। ‘১৭ দিন আগে’ ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা ‘শিন বেত’ এবং ইসরাইলি পুলিশ ঘোষণা করেছিল, তারা রয় মিজরাহী এবং এলমগ আতিয়াস নামে ২৪ বছর বয়সী দু’ তরুণকে গ্রেফতার করেছে। তারা ইসরাইলের ‘নেসার’ শহরের বাসিন্দা এবং তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা ইরানের পক্ষে গুপ্তচরগিরি চালানোর অপরাধে জড়িত ছিল।

ইসরাইলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই গ্রেফতারকৃতদের ইরানের গোয়েন্দা অভিযানের সাথে যুক্ত থাকার কথা বলা হয়নি। কিন্তু ইরানি সংবাদমাধ্যম মনে করছে, ইহুদিবাদী গোপন দলিলপত্র পাচারের সাথে গ্রেফতারে সম্পর্ক রয়েছে। ধারণা, এই দু’জন ইসরাইল থেকে দলিলপত্র পাচারের পরপরই আটক হয়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরাইলের বহুদিন ধরেই চলেছে ইরানে গোপন ও প্রকাশ্য অভিযান চালিয়ে আসছে। ইরানও তার পাল্ট জবাব অব্যাহত রেখেছে। সাইবার হামলা, সরাসরি হামলা, ড্রোন আক্রমণ এবং গোপন নাশকতা তারই অংশ। তেহরান বহুবার অভিযোগ করেছে, ইসরাইল ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যায় জড়িত। অন্যদিকে ইসরাইল ধুয়া তুলছে, ইরান মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন উগ্রবাদী গোষ্ঠীকে সহায়তা করে এবং বিশ্বজুড়ে ইসরাইলি স্বার্থে আঘাত হানছে।

এই পরিস্থিতিতে এই সাম্প্রতিক গোয়েন্দা সফলতা ইরানের জন্য কূটনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে বড় জয় হিসেবেই দেখা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ইরানের হাতে ইসরাইলের এই পরমাণু পরিকল্পনা সংক্রান্ত গোপন তথ্য চলে আসা এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। ইরান পরমাণু বোমা তৈরির চেষ্টা করছে বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল অভিযোগের জিগির তুলেছে। তাদের দাবি ইরান মধ্যপ্রাচ্যে পরমাণু ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টায় লিপ্ত। যদিও ইরান বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং বলেছে, তেহরান নন-প্রোলিফারেশন ট্রিটি বা বা পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি অর্থাৎ সংক্ষেপে এনপিটতে ইরান সই করেছে সে চুক্তি অনুযায়ী শুধু শান্তিপূর্ণ পরমাণু শক্তি ব্যবহারের অধিকার চাচ্ছে।

এদিকে আবার ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলিতে বোমা হামলার পক্ষে বারবার বক্তব্য ঝাড়ছেন। তার মতে, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ইসরাইলের অস্তিত্বের জন্য হুমকি।

এদিকে, ইসরাইল কখনো মুখে স্বীকার না করলেও, তাদের হাতে অন্তত ৮০ থেকে ৯০টি পরমাণু বোমা রয়েছে বলে আন্তর্জাতিকভাবে ধরেই নেয়া হয়। ১৯৮৬ সালে মোর্দেখাই ভানুনু নামের এক ইসরাইলি পারমাণবিক টেকনিশিয়ান ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য সানডে টাইমসকে সাক্ষাৎকার দিয়ে ডাইমোনার গোপন ছবি ও তথ্য প্রকাশ করেন।

তার এই ফাঁসের মাধ্যমেই বিশ্ব জানতে পারে ইসরাইলের গোপন পারমাণবিক কর্মসূচির ব্যাপারে। ভানুনুকে পরে অপহরণ করে ইসরাইলে আনা হয় এবং ১৮ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।

ইসরাইলের পরমাণু বোমা এক ধরনের ‘নিয়ন্ত্রিত গোপন সত্য’, যার অস্তিত্ব অস্বীকার করা হলেও তার প্রভাব এবং ভয়াবহতা পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে প্রভাবিত করে চলেছে।

গত বছর থেকে চলমান ‘গাজা যুদ্ধ’-এর সময়ই ইরান ও ইসরাইল একাধিকবার সরাসরি আঘাত হানে একে অপরের ওপর। আর তেহরান ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকেই ফিলিস্তিনি সংগ্রামের প্রতি সমর্থন দিয়ে আসছে এবং ইসরাইলকে ফিলিস্তিনি ভূমি দখলদার হিসেবে দেখে এবং তেলআবিবকে কখনো স্বীকৃতি দেয়নি।

ইরানের এই নতুন গোয়েন্দা ঘটনা সেই বহু দশকের শীতল-উষ্ণ সঙ্ঘাতকে আরো নতুন রূপ দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

ইসরাইলের গোপন পরমাণু দলিল ইরানের হাতে পৌঁছানো এক যুগান্তকারী ঘটনা, যা শুধু দুই দেশের সম্পর্ক নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্যে বড়সড় পরিবর্তন আনতে পারে। ভবিষ্যতে এই ঘটনার প্রভাব কতদূর বিস্তার লাভ করে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

মুল্যবান মন্তব্য করুন