ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আস্থাভাজন কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত এবং সুবিধাবাদীরা এখনো ‘নানা কৌশলে’ সচিব পদে পদোন্নতি বাগিয়ে নিচ্ছেন। ইতোমধ্যে যাদেরকে পদোন্নতি প্রদান করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, অতীতে তারা প্রত্যেকেই প্রশাসনের বিভিন্ন লোভনীয় পদে পোস্টিং পেয়ে নিজেদের আখের গুছিয়েছেন। ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে বিভিন্ন সময় তারা পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের সাথে নিয়ে টুঙ্গিপাড়ায় শেখ মুজিবুর রহমানের মাজার জিয়ারত করতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
নতুন করে আওয়ামী সুবিধাবাদীদের সচিব পদে পদোন্নতির খবর প্রকাশ পাওয়ার পর থেকেই প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়সহ সর্বত্র ক্ষোভ বিরাজ করছে।
বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তারা প্রশ্ন রেখে জানতে চাচ্ছেন, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পালিয়ে গেলেও তাদের দোসর আমলাদের এখনো কিভাবে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে পদোন্নতি দিয়ে পোস্টিং দেয়া হচ্ছে? এসব কার স্বার্থে করা হচ্ছে?
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো: মফিদুর রহমানকে সচিব পদে পদোন্নতি দিয়ে একই মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। বেশ কিছু দিন থেকে সংস্কৃতি সচিবের রুটিন দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন মফিদুর রহমান। এর আগে গত ২৪ মার্চ ১৫তম বিসিএসের কর্মকর্তা মো: মফিদুর রহমানসহ দু’জন কর্মকর্তাকে সচিব বানানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
অথচ সচিব পদে নিয়োগ দেয়ার জন্য ছয় মাস আগেই বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার নামসহ প্রধান উপদেষ্টার স্বাক্ষর করা সার-সংক্ষেপ পাঠানো হলেও তাদের সেই ফাইল প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের দফতরে রহস্যজনক কারণে আটকে আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বঞ্চিত কর্মকর্তারা সচিব পদে নিয়োগ পেতে এসব কর্মকর্তাদের সাথে সরাসরি দেখা করতে গেলে তাদেরকে আশার বাণী শোনানো পর্যন্তই। তাদেরকে আর পদায়ন করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ বঞ্চিতদের।
প্রশাসনে ১৬ বছর বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তারা নিজেদের নাম না প্রকাশ করার শর্তে অভিযোগ করে গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, পলাতক শেখ হাসিনার সরকারের সময় সব ধরনের পদোন্নতি পেয়েছেন, ভালো ভালো জায়গায় চাকরি করেছেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো: মফিদুর রহমান। শুধু তাই নয়, প্রত্যেকবার পদোন্নতি প্রাপ্তির পর পদোন্নতিপ্রাপ্ত সবাইকে নিয়ে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের মাজার জিয়ারতে যাওয়ারও নেতৃত্ব দিয়েছেন। স্বৈরাচারের আমলে বাংলাদেশ টেলিভিশনে মুজিব ও আওয়ামী বন্দনার অনুষ্ঠানের সঞ্চালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের একজন পুরোধা ও নেপথ্যের অর্গানাইজার ছিলেন। সম্প্রতি তিনি সচিব পরিচয় দিয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে ঢুকে পড়েছিলেন বি না পাসে। এ নিয়ে বিশৃঙ্খল অবস্থা হয়েছিল বলে তারা ক্ষোভের সাথে অভিযোগ করেন।
এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে গতকাল শুক্রবার সচিব পদে পদোন্নতি পাওয়া মো: মফিদুর রহমানের বক্তব্য নিতে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
একইভাবে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (সংযুক্ত) ড. এ কে এম শাহাবুদ্দিনকে সচিব পদে পদোন্নতি দেয়ার বিষয় চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। যে কোনোদিন তাকেও পদোন্নতি দেয়া হতে পারে বলে বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তারা জানান। তার বিরুদ্ধেও একই ধরনের অভিযোগ এনে নির্যাতিত কর্মকর্তারা বলছেন, চরম সুবিধাবাধী কর্মকর্তাদের মধ্যে তিনি একজন। তিনিও শেখ মুজিবুর রহমানের মাজার জিয়ারতকারী ও নেতৃত্বদানকারী কর্মকর্তা। স্বৈরাচার আমলে নিজের পদ পদবি রক্ষার্থে অপর ব্যাচমেটদের বলি দিতে দ্বিধা করতেন না তিনি। ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত বলে সবাইকে বলতেন। আর এখন হঠাৎ ভোল পাল্টাতে শুরু করেছেন। এমন বেশ কয়েকজন সুবিধাবাদী অতিরিক্ত সচিব পদের কর্মকর্তাকে সচিব পদে নিয়োগ দেয়ার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে সার-সংক্ষপ তৈরি করে পাঠানো হয়েছে। এসব কর্মকর্তার পদোন্নতি-পদায়নে যারা নেপথ্যে অথবা প্রকাশ্যে থেকে পৃষ্ঠপোষকতা করছেন তাদেরকে দ্রুত জবাবদিহিতার আওয়ায় আনার জন্য বৈষম্যবিরোধী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পক্ষ থেকে জোর দাবি জানানো হয়েছে।
যদিও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রশাসনে বঞ্চিত ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে সচিব পদে ১১৯ জন, অতিরিক্ত সচিব পদে ৫২৮ জন, গ্রেড-১ পদে ৪১ জন, যুগ্মসচিব পদে ৭২ জন এবং উপসচিব পদে ৪ জনকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। তারপরও এখনো অনেক কর্মকর্তাই পদবঞ্চিত রয়েছেন বলে জানা যায়। ভুক্তভোগী কর্মকর্তারা নয়া দিগন্তকে বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কর্ণধার সচিবরা এ কেমন মরণ খেলা শুরু করলেন! ডক্টর ইউনূস স্যার কি জানেন, তার প্রভাবশালী চুক্তির আমলারা তাকে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ করে যাচ্ছেন? যেখানে আওয়ামী সুবিধাভোগী সচিবদেরকে এখনো তারা অবসরে পাঠাননি। উপরন্তু আরো আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তাদের সচিব বানাতে যাচ্ছেন।
এদিকে অতিরিক্ত সচিবদের মধ্যে মো: নাসির উদ্দিন আহমেদ, মজিবর রহমান, নীলিমা আখতার, মো: মুহিবুজ্জামান, নুজহাত ইয়াসমিন, প্রদীপ কুমার দাস, হুমায়ুন কবীর, মো: জাকির হোসেন, বেগম শাকিলা জেরিন, আবু তাহের মুহাম্মদ জাবেরসহ ১৩৯ কর্মকর্তাকে দ্রুত প্রত্যাহার ও তাদের সার্বিক কর্মকাণ্ডের ওপর নজরদারি বাড়ানোর জন্য বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে একটি তালিকা তৈরি করে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে দেয়া হয়েছে।