৫ আগস্টের পর ৭ হাজার ৮২২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সেনাবাহিনী
আরিফুল ইসলাম
, প্রকাশ:18 এপ্রিল 2025, 11:57 দুপুর
আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনীর গত দুই মাসের কার্যক্রম তুলে ধরে সেনা সদরের মিলিটারি অপারেশন্স ডাইরেক্টরেটের কর্নেল স্টাফ কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, এ সময়ে দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অন্যান্য সব আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বিত উদ্যোগে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ২ হাজার ৪৫৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। ৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত মোট ৭ হাজার ৮২২ জনকে বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার করেছে। বৃহস্পতিবার বেলা আড়াইটার দিকে ঢাকা সেনানিবাসে প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এসব তথ্য জানান। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত মার্চ ফর গাজা ও আগে কয়েকটি জায়গায় দেখা গেছে নিষিদ্ধ সংগঠনের পতাকা হাতে নিয়ে মিছিল করতে। এক্ষেত্রে সেনাবাহিনী কি পদক্ষেপ নিচ্ছে জানতে চাইলে সেনাবাহিনীর এই কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত মার্চ ফর গাজার বিক্ষোভে সেনাবাহিনী কালো পতাকাধারীদেরকে রহিত করেছে। কালো পতাকাধারী হলেই যে সে জঙ্গি সংগঠনের এটির কোনো প্রমাণ আমরা এখনও পায়নি। তবে এ বিষয়ে সেনাবাহিনী সোচ্চার রয়েছে। গোয়েন্দা বাহিনীও তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। মিয়ানমার সীমান্তে আরাকান আর্মিরা বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করে জেলে ও মাছ ধরাভর্তি ট্রলার ধরে নিয়ে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনী কি পদক্ষেপ নিচ্ছে জানতে চাইলে কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, নাফ নদীতে জেলেদের যে অসুবিধা হচ্ছে এ বিষয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড ও বিজিবি দায়িত্বপ্রাপ্ত। তাদের কাজ চলমান আছে। অনেক জেলে বাংলাদেশে ফেরত আনা হয়েছে। বাকিদের বিষয়েও প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। প্রয়োজন হলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অথবা নৌ বাহিনী দায়িত্ব পালন করবে। গত ৮ মাস ধরে সশস্ত্র বাহিনী আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতায় মাঠে কাজ করছে। কাজ করতে গিয়ে রাজনৈতিক দলের কোনো চাপ পাচ্ছে কি না জানতে চাইলে কর্নেল শফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা কাজ করতে গিয়ে কোনো বাধা পাচ্ছি না। আমরা যে কোনো অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে হস্তান্তরের পর পরবর্তী আইনি বিচারকার্য সেনাবাহিনীর দায়িত্বের বহির্ভূত। ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতায় সেনাবাহিনী কাজ করে যাচ্ছে, যেখানে যতটুকু ব্যবহার করার দরকার ততটুকুই ব্যবহার করা হচ্ছে। খাগড়াছড়ি থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) পাঁচ শিক্ষার্থীকে অপহরণের ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অপহৃত পাঁচ শিক্ষার্থীর অবস্থান কিছুটা শনাক্ত করা গেছে। এ বিষয়ে বিশেষ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। বিভিন্ন সময় সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধানকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব দেখা যাচ্ছে। এ বিষয়ে সেনাবাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে সেনাবাহিনীর এই কর্মকর্তা বলেন, কোনো রকম গুজবে সেনাবাহিনী বিচলিত নয়। বরং সেনাবাহিনী আরও একতাবদ্ধ হয়ে দেশ ও জাতির পাশে কাজ করে যাচ্ছে। সম্প্রতি সেনাপ্রধানের রাশিয়া ও ক্রোয়েশিয়া সফরের বিষয়ে জানতে চাইলে কর্নেল শফিকুল ইসলাম বলেন, বন্ধু প্রতিম দেশের সঙ্গে সম্প্রতি সেনাপ্রধানের রাশিয়া ও ক্রোয়েশিয়া সফর একটি নিয়মিত কার্যক্রম। এই সফরে সেনাপ্রধান বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি পরিদর্শন করেন। এর ফলে সামরিক সহযোগিতা আরও প্রগাঢ় হবে। এর আগে প্রেস ব্রিফিংয়ে কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম জানান, গত দুই মাসে দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনী অন্যান্য সকল আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সমন্বিত উদ্যোগে বিভিন্ন ধরণের অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত মোট ২,৪৫৭ জনকে এবং এ যাবত পর্যন্ত সর্বমোট ৭,৮২২ জন্যক বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার করেছে। যাদের মাঝে কিশোর গাং তালিকাভূক্ত অপরাধী, মাদক ব্যবসায়ী, অপহরণকারী, চোরাচালানকারী, প্রতারক ও দালাই চত্র, চাঁদাবাজ, ডাকাত, ছিনতাইকারী ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এরই ধারাবাহিকতায় গত দুই মাসে সেনাবাহিনী ৩২০টি অবৈধ অস্ত্র ও ৫৬৪ রাউন্ড গোলাবারুদ এবং এ যাবত পর্যন্ত সর্বমোট ৯,৩৭০টি অবৈধ অস্ত্র ও ২,৮৫,০৫২ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে। তিনি আরো বলেন, ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে ঘরমুখ মানুষের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ও সুশৃঙ্খল যানবাহন চলাচল নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনী ঈদের আগে ও পরে মিলে ২ সপ্তাহের বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করে। এর অংশ হিসেবে জাতীয় মহাসড়কগুলোতে নির্বিঘ্নে যান চলাচল নিশ্চিত করতে ঢাকাসহ দেশের সকল জেলার বাস স্ট্যান্ড, রেল স্টেশন, এবং লঞ্চ টার্মিনাল ও মহাসড়কে দিন-রাত টহল পরিচালনা, স্পর্শকাতর স্থানে চেকপোস্ট স্থাপন এবং জনগণের মধ্যে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় যা মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। ফলশ্রুতিতে, সড়ক দূর্ঘটনাসহ অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকান্ড গত বছরের তুলনায় বহুলাংশে হ্রাস পায় যা জনসাধারণকে নির্বিঘ্নে গন্তব্যে পৌঁছানোসহ পরিবার-পরিজনের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ ও আনন্দঘনভাবে ঈদ উদযাপনে সহায়ক ভূমিকা রাখে। তিনি আরও জানান, বিগত সময়ে শিল্পাঞ্চল সমূহের নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ১৩৭টি ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন করেছে এবং ৩১ বার বিভিন্ন মূল সড়ক অবরোধ থেকে অবমুক্ত করেছে। শিল্পাঞ্চলে জাতীয় নিরাপত্তা বিধানকালে গত ৯ এপ্রিল নারায়নগঞ্জে অবস্থিত রবিন টেক্স গার্মেন্টসে অস্থিরতা প্রশমন কালে নিয়োজিত সেনাসদস্যগণ কিছু গার্মেন্টস শ্রমিক কর্তৃক ইট পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনায় আক্রান্ত হয় এবং এতে ২৪ জন সেনা সদস্য আহত হয়। ঈদ পূর্ব গার্মেন্টসে অস্থিরতা মোকাবিলায় সেনাবাঘিনী মালিকপক্ষ, শ্রমিকপক্ষ, মন্ত্রণালয়, শিল্পাঞ্চল পুলিশ ও ইএগঊঅ সহ সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে সমন্বয় সাধন করে শ্রমিকদের বেতন ও ভাতা পরিশোধে বিশেষ ব্যবস্থা করে যা শ্রমিকদের মাঝে ঈদ পূর্ববর্তী গতানুগতিক অস্থিরতা প্রশমনে অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা রাখে। তিনি বলেন, শিল্পাঞ্চল ছাড়াও সেনাবাহিনী বিগত দুই মাসে ২৩২টি বিভিন্ন ধরণের বিশৃংখল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে, যার মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত ঘটনা ছিল ৩৭টি, সরকারী সংস্থা, অফিস সংক্রান্ত ২৪টি, রাজনৈতিক কোন্দল ৭৬টি এবং অন্যান্য বিভিন্ন ধরণের ঘটনা ছিল ১৫টি। তিনি আরও জানান, ১৩ তারিখে সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলাতে খোলাপেটুয়া নদীর প্রায় ৩০০ মিটার বাঁধ ভেঙে গেলে আশে-পাশের প্রায় ৯টি গ্রাম প্লাবিত হয়। এই ঘটনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যগণ পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় জনগনকে সম্পৃক্ত করে দ্রুততম সময়ে বাঁধটি মেরামত করতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রত্যন্ত অঞ্চলে পানিবন্দী মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ত্রাণ পৌঁছে দেয়। কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম আরও জানান, গত ২৮ মার্চ ৭.৭ মাত্রার ভূমিকম্প মায়ানমার এবং থাইল্যান্ডে আঘাত হানে যার ফলে জানমালের ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতি হয়। এ ভূমিকম্পে মায়ানমারে মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। প্রতিবেশী দেশের বিপদসংকুল এসময়ে বাংলাদেশ সরকার জরুরী উদ্ধার, ত্রাণ ও চিকিৎসা সহায়তা প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করে। সেনাবাহিনীর কর্নেল শামীমের নেতৃত্বে ইঞ্জিনিয়ার কোরের ২১ জনের একটি উদ্ধারকারী দল এবং ১০ জনের একটি মেডিকেল দল প্রেরণ করা হয়। সেনাবাহিনী ছাড়াও নৌবাহিনীর ৩ জন, বিমানবাহিনীর ৩ জন, ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স এর ১০ জন এবং ৮ সদস্য বিশিষ্ট একটি অসামরিক মেডিকেল দল প্রেরণ করা হয়। এই উদ্ধার, ত্রাণ ও চিকিৎসা সহায়ক দল প্রেরণের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর বিমান, বিমান বাহিনীর বিমান ও নৌ জাহাজ ব্যবহার করা হয়। তিনি বলেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি বৈষম্য-বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন সময়ে যারা আহত হয়েছেন, তাদের সুচিকিৎসার জন্য সেনাবাহিনী অদ্যাবধি ৪ হাজার ৩৪০ জনকে দেশের বিভিন্ন সিএমএইচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। যার মধ্যে ৪৩ জন এখনো চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহতদের সম্মানে সেনাবাহিনী গত ২৩ মার্চ সেনামালঞ্চে ইফতার ও দোয়া মাহফিল আয়োজন করে। ২৫ মার্চ আর্মি মাল্টিপারপাস কমপ্লেক্সে আহত এবং শহীদ পরিবারের সম্মানে সংবর্ধনা আয়োজন করা হয়। সেনাবাহিনী প্রধান উপস্থিত থেকে সকলের খোঁজ-খবর নেন। চিকিৎসাসহ সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন।