৭ মাসে হাসিনাসহ ৪ শতাধিক ব্যক্তির ১৬ হাজার কোটি টাকার সম্পদ জব্দ

আরিফুল ইসলাম , প্রকাশ:26 এপ্রিল 2025, 03:54 দুপুর
news-banner

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত সাত মাসে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যসহ ৪ শতাধিক ব্যক্তির প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এসব ব্যক্তির সম্পদ জব্দের আদেশ দেন।

সন্দেহজনক লেনদেন, অর্থপাচার, অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদ গড়ার অভিযোগ ওঠা ওই ব্যক্তিদের তালিকায় শেখ হাসিনা ও তার পরিবার ছাড়াও সাবেক মন্ত্রী, এমপি, বিতর্কিত ব্যবসায়ী, গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার শীর্ষ পদে থাকা ব্যক্তিরা রয়েছেন।

দুদক সূত্র জানায়, যাদের সম্পদ জব্দ করা হয়েছে সেই তালিকার মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ (জয়) ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ (পুতুল), শেখ রেহানা, তার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকি (ববি)।

এ ছাড়া রয়েছেন, এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা সালমান এফ রহমান, সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, সাবেক মন্ত্রী দীপু মনী, জুনায়েদ আহমেদ পলক, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদসহ সাবেক সরকারের মন্ত্রী, এমপি ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাব ও সম্পদ জব্দ করা হয়েছে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে টানা ১৬ বছরের আওয়ামী লীগের নজিরবিহীন দুঃশাসন ও স্বেচ্ছাচারিতার অবসান ঘটে। সরকার পতনের পর তার আমলের মন্ত্রী, এমপি, সহযোগীসহ গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার শীর্ষ পদে থাকা ব্যক্তিদের দুর্নীতি, অর্থপাচার ও ঋণ কেলেঙ্কারির খবর বেড়িয়ে আসছে। হাসিনা পালানোর সঙ্গে সঙ্গে অভিযুক্ত ব্যক্তিরাও গা ঢাকা দেন। অনেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আটক ও গ্রেফতার হন। এমন পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের দায়িত্ব নেয়ার পর আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাব তলব ও জব্দ করে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউ। একই সঙ্গে তাদের স্ত্রী, সন্তানসহ ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত করা হয়।

বিএফআইইউর একাধিক কর্মকর্তা জানান, অর্থপাচার রোধ ও পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আপসহীন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রথমত পাচারের সঠিক তথ্য উদ্ধার, পরিমাণ নির্ণয় ও পরে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার দিকে আগানো হবে। এ ক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। যদি কোনো প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গ্রুপের বিরুদ্ধে পাচারের তথ্য প্রমাণিত হয় তাহলে জড়িতদের বিরুদ্ধে নেয়া হবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। কিন্তু তাদের ব্যবসায় ক্ষত সৃষ্টি হতে দেয়া হবে না।

বিএফআইইউর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের দায়িত্ব নেয়ার পর সন্দেহজনক লেনদেন ও বিদেশে অর্থপাচারের অভিযোগে দেড় হাজারের বেশি ব্যাংক হিসাব তলব ও জব্দ করছে বিএফআইইউ। তবে ৮ আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বিএফথআইইউ, এনবিআর এবং দুদক যৌথ প্রচেষ্টায় ৩৬৬ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছে। তাদের অ্যাকাউন্টে ১৫ হাজার কোটি টাকা পাওয়া গেছে।

গত ২৯ সেপ্টেম্বর বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ দেশে ফেরত আনা এবং ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্স পুনর্গঠন করেছে সরকার। এ টাস্কফোর্সের সভাপতি করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে। টাস্কফোর্সের কার্যপরিধির মধ্যে রয়েছে, বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ বা সম্পদ চিহ্নিত করা, পাচার করা সম্পদ উদ্ধার হওয়া মামলাগুলোর কার্যক্রম দ্রুত নিষ্পত্তি করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করা ও তা দূর করার উদ্যোগ নেয়া, বিদেশে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নেয়া, জব্দ বা উদ্ধার সম্পদের ব্যবস্থাপনার জন্য উদ্যোগ নেয়া, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশ, বিদেশী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ ও তথ্য আহরণ করা এবং পাচার করা সম্পদ উদ্ধারে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি ও অভ্যন্তরীণ সমন্বয় সাধন।

দুদকের তথ্য অনুযায়ী, গত সাত মাসে শতাধিক আদেশে দেশের মধ্যে ১০ হাজার ৩১০ কোটি টাকা এবং বিদেশে থাকা ১৬৫ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। দুদক জানায়, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই দলের বিভিন্ন নেতাকর্মী ও ব্যবসায়ীদের সম্পদ আদালতের মাধ্যমে জব্দ করা হয়েছে।

দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৫ আগস্ট থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে ১০ হাজার ৩১০ কোটি ২৬ লাখ টাকা এবং বিদেশে ১৬৫ কোটি ৬১ লাখ টাকার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।

এ ছাড়া, আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী আনিসুল হক, জুনায়েদ আহমেদ পলক, ব্যাংক খাতে হাজার কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগে এস আলম গ্রুপ এবং বিদেশে বিনিয়োগকারী বিভিন্ন গ্রুপের সম্পদও ইতোমধ্যে জব্দ করা হয়েছে।

শেখ হাসিনা ও রেহানা পরিবারের ৩৯৪ কোটি টাকা ফ্রিজ

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজিব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ৩১টি ব্যাংক হিসাবের ৩৯৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা ফ্রিজ (অবরুদ্ধ) করা হয়েছে।

গত ১৮ মার্চ দুদকের উপ-পরিচালক ও এ সংক্রান্ত অভিযোগের অনুসন্ধান কর্মকর্তা মনিরুল ইসলামের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজের আদালত এসব অর্থ ফ্রিজের আদেশ দেন।

দুদকের মহাপরিচালক মো: আক্তার হোসেন বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজিব ওয়াজেদ জয়, তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, তার ছোট বোন শেখ রেহানা ও তাদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ৩১টি ব্যাংক হিসাবের ৩৯৪ কোটি ৬০ লাখ ৭৩ হাজার টাকা অবরুদ্ধ করা হয়েছে।

এর আগে গত ১১ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজিব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ও ছোট বোন শেখ হাসিনা ও তাদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ১২৪টি ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ ও শেখ হাসিনার ধানমন্ডির বাসভবন সুধাসদনসহ তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা আরও কিছু সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ দেন একই আদালত। একই সঙ্গে হাসিনাসহ পরিবারের সাতজনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞাও দেয়া হয়।

সাবেক মন্ত্রী তাজুলের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট

সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলামের ৭৬৭ দশমিক ৬৭ কাঠা স্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ও ৩৪টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেনের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় গত ১৩ এপ্রিল ঢাকা মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতের বিচারক এ আদেশ দেন।

এস আলম ও পরিবারের সম্পদ জব্দ

এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম, তার পরিবারের সদস্য ও তাদের সুবিধাভোগীদের নামে ৯ হাজার ৬৪৬ কাঠা স্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৩ এপ্রিল ঢাকা মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতের বিচারক এই সম্পদ বাজেয়াপ্তের আদেশ দেন।

এর আগে, গত ৯ এপ্রিল একই আদালত সাইফুল আলম, পরিবারের সদস্য ও তাদের সুবিধাভোগীদের নামে প্রায় ৮ হাজার কাঠা স্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের নির্দেশ দেন।

১৭ এপ্রিল একই আদালত এস আলম, পরিবারের সদস্য ও সুবিধাভোগীদের নামে ১ হাজার ৩৬০টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দের নির্দেশ দেন।

এর আগে, ৩০ জানুয়ারি আদালত তাদের ৩৬৮ কোটি টাকা মূল্যের ৫৮ একর স্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেন।

১৬ জানুয়ারি আদালত এস আলম ও পরিবারের সদস্যদের মালিকানাধীন ৩৫০ কোটি টাকা মূল্যের ২৪ কোম্পানির ৩২ কোটির বেশি শেয়ার জব্দের নির্দেশ দেন।

১৪ জানুয়ারি একই আদালত এই পরিবারের সদস্যদের নামে ২০০ কোটি টাকা মূল্যের স্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার এবং পরিবারের ১৬ সদস্যের ৮৭ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দের নির্দেশ দেন।

মুল্যবান মন্তব্য করুন