আটা-ময়দার ট্যাবলেট ও ভেজাল ওষুধের বিস্তারে অসহায় মানুষ

আরিফুল ইসলাম , প্রকাশ:28 মে 2025, 03:50 দুপুর
news-banner

জুলাই আন্দোলনের পর রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে আবারো সক্রিয় হয়ে উঠেছে ভেজাল ও নকল ওষুধের কারবারিরা। শহর থেকে শুরু করে গ্রাম, সবখানেই ছড়িয়ে পড়ছে নকল ও ভেজাল ওষুধ। এ নিয়ে রোগী ও চিকিৎসকদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে।

জানা গেছে, বাজারে কিছু কিছু ওষুধের ক্ষেত্রে ভেজাল ও নকল এতটাই বেড়েছে, চিকিৎসকদের অনেকে ওষুধগুলোর ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছেন। অনেক চিকিৎসক এসব ওষুধ লেখা বন্ধ করে দিয়েছেন।

এমন একটি ওষুধের নাম ‘অ্যালবুমিন ইনজেকশন’, যা সাধারণত বড় ধরনের অস্ত্রোপচার বা গুরুতর আঘাত পরবর্তী চিকিৎসায় রক্তে প্লাজমার পরিমাণ বাড়ানোর কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

কিন্তু ওষুধটির নকল ও ভেজালে এখন বাজার সয়লাব বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা।

বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা: চঞ্চল কুমার ঘোষ বলেন, ‘বাজারে অ্যালবুমিন ইনজেকশনের নকল যে পরিমাণ বেড়েছে, তাতে আমরা এটা দেয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছি।’

উল্লেখ্য, অ্যালবুমিন ব্যবহারের পরও বছরখানেক আগে সিলেটে এক রোগীর মৃত্যু হয়। এছাড়া ঢাকার বেশকিছু হাসপাতালে রোগীদের শরীরে জটিলতা দেখা দেয়ায় ইনজেকশনটি পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। এরপরেই চিকিৎসকরা নকলের বিষয়টি নিশ্চিত হন।

চিকিৎসকরা বলছেন, ‘নকল অ্যালবুমিন ইনজেকশনটি দেখতে অনেকটা আসলের মতো, খালি চোখে দেখে সেটা পার্থক্য করা যায় না।’

ডা: চঞ্চল কুমার ঘোষ বলেন, ‘সাধারণ মানুষ কিভাবে বুঝবে, তারা অসহায় অবস্থায়। আমরাই তো অনেক সময় বুঝতে পারি না কোনটা আসল আর কোনটা নকল। দেখতে অনেকটা একইরকম লাগে। সেজন্য এটা ব্যবহার না করার চেষ্টা করি।

বিজ্ঞানবিষয়ক আন্তর্জাতিক সাময়িকী নেচারে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, শুধুমাত্র ঢাকা শহরে বিক্রি হওয়া অ্যান্টিবায়োটিকের মধ্যে প্রায় ১০ ভাগ ওষুধই নকল, ভেজাল এবং নিম্নমানের।

ঢাকার বাইরে এই পরিস্থিতি আরো খারাপ বলে জানিয়েছে গবেষকরা।

ভোক্তাদের অভিযোগ, অনেকক্ষেত্রে আটা-ময়দা দিয়ে বানানো নকল বড়ি বিক্রির ঘটনাও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তা বন্ধ করার জন্য যে ধরনের কঠোর হওয়া প্রয়োজন, সরকারের পক্ষ থেকে তা করা হচ্ছে না।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস-প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘এক্ষেত্রে আমরা সরকারের আন্তরিকতার ঘাটতি দেখছি। যার কারণে কঠোর আইন থাকার পরও বাজারে ভেজাল ও নকল ওষুধের দৌরাত্ম্য দেখা যাচ্ছে।’

উল্লেখ্য, নকল ও ভেজাল ওষুধ ঠেকাতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রেখে ২০২৩ সালে ওষুধ ও কসমেটিক আইন পাস করে বাংলাদেশ সরকার। এরপর ওই আইনে এখন পর্যন্ত কাউকে যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হয়নি।

ঢাকার বাইরে বেশি ভেজাল-নকল

স্বাস্থ্যখাতের গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা শহর থেকে দেশের প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত সবখানেই ভেজাল ও নকল ওষুধ ছড়িয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে যেসব ওষুধের চাহিদা এবং দাম বেশি, সেগুলোরই নকল ও ভেজাল বাজারে বেশি দেখা যাচ্ছে।

ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের স্কুল অব মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, ‘এক্ষেত্রে গ্যাস্ট্রিক কিংবা অ্যান্টিবায়োটিকের ওষুধই উদাহরণ। সারাদেশেই এগুলোর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সে কারণে অসাধু ব্যক্তিরা সেগুলোর নকল বের করে সারাদেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে।’

বিজ্ঞানবিষয়ক আন্তর্জাতিক সাময়িকী নেচারে বাংলাদেশের ওষুধের মান নিয়ে যে গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে, সেটির নেতৃত্বে ছিলেন ড. মহিউদ্দিন আহমেদ ভূঁইয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের ফার্মেসি বিভাগের সাথে ওই গবেষণায় যৌথভাবে কাজ করেছে জাপানের কানাজাওয়া ইউনিভার্সিটি এবং জার্মানির এবাহার্ড কার্ল ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক।

গবেষণাটিকে তারা দু’ভাগে বিভক্ত করছেন, যেখানে প্রথমভাগে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে তিন ধরনের গ্যাস্ট্রিক ও অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের ১৮৯টি নমুনা সংগ্রহ করে সেগুলোর মান পরীক্ষা করে দেখেন গবেষকরা।

ওষুধগুলো হলো ইসোমিপ্রাজল, সেফিক্সিম এবং অ্যামোক্সিসিলিন-ক্লাভুলানিক অ্যাসিড। এর মধ্যে ইসোমিপ্রাজল গ্যাস্ট্রিকের সমস্যায় নিরসনে ব্যবহার হয়। আর সেফিক্সিম এবং অ্যামোক্সিসিলিন-ক্লাভুলানিক অ্যাসিড মূলত অ্যান্টিবায়োটিক, যা সাধারণত নিউমোনিয়া ও প্রস্রাবের সংক্রমণের মতো রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

নমুনাগুলোর মধ্যে ৭৮ দশমিক ছয় শতাংশ খুচরা বিক্রেতাদের থেকে এবং ২০ দশমিক নয় শতাংশ সংগ্রহ করা হয় ওষুধের পাইকারি বিক্রেতাদের কাছ থেকে।

২০২২ সালে গবেষণাটির প্রধম ধাপের ফলাফলে প্রকাশিত হয়। সেখানে ঢাকায় সংগ্রহ করা নমুনায় নকল, ভেজাল এবং নিম্নমানের ওষুধের পরিমাণ ছিল প্রায় ১০ শতাংশ।

গবেষণার দ্বিতীয় ধাপে ঢাকার বাইরের জেলাগুলো থেকে গ্যাস্ট্রিক ও অ্যান্টিবায়োটিকে ওই তিন ধরনের ওষুধের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়েছে। সেখানে ঢাকার থেকে প্রায় দ্বিগুণ, অর্থাৎ প্রায় ২০ শতাংশের মতো নকল, ভেজাল এবং নিম্নমানের ওষুধ পেয়েছেন গবেষকরা।

ড. মহিউদ্দিন আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, ‘এটা বেশ উদ্বেগজনক এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য রীতিমতো হুমকি বলে মনে করছি আমরা।’

গবেষকরা বলছেন, ‘নকল ওষুধের কোনো কোনোটির মধ্যে উপাদান হিসেবে আটা-ময়দাও পাওয়া যাচ্ছে।

বাজারে বাড়ছে আটা-ময়দার ট্যাবলেট

যেসব ওষুধের নকল তৈরি হচ্ছে, সেগুলোতে উপাদান হিসেবে আটা-ময়দা, এমনকি সুজি ব্যবহার করার প্রমাণ পেয়েছেন গবেষকরা।

এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, ‘ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের জেলা, সবখানেই আমরা এটা পেয়েছি। তবে ঢাকার বাইরে আটা-ময়দার এরকম নকল ওষুধ বেশি দেখা গেছে।

পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, অতীতে পুলিশের হাতেও এ ধরনের ওষুধ উৎপাদনকারীর ধরা পড়েছে। ২০২৪ সালের মার্চে ঢাকা ও বরিশালে অভিযান চালিয়ে আটা, ময়দা এবং সুজি ব্যবহার করে নকল ওষুধ উৎপাদনকারী একটি দলের পাঁচজন সদস্যকে গ্রেফতার করেছিল গোয়েন্দা পুলিশ। তাদের কাছ থেকে তখন বিভিন্ন ধরনের প্রায় পাঁচ লাখ নকল অ্যান্টিবায়োটিক উদ্ধার করা হয়। দলটির সদস্যরা প্রায় দশ বছর ধরে নকল ওষুধ তৈরি ও বিক্রি করছিল।

বেশি নকল হচ্ছে যে ধরনের ওষুধ

গবেষক ও চিকিৎসকরা বলছেন, যেসব ওষুধের চাহিদা ও দাম বেশি, বাজারে সেসব ওষুধের নকল বেশি দেখা যাচ্ছে। চাহিদা থাকার পরও বাজারে সহজে পাওয়া যায় না, এমন ওষুধেরও নকল বের হচ্ছে। এক্ষেত্রে দেশে উৎপাদিত ওষুধের পাশাপাশি অনেক বিদেশী ওষুধও নকল হতে দেখা যাচ্ছে।

গবেষক ও ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষক ড. মহিউদ্দিন আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, যেহেতু চাহিদা রয়েছে এবং দামও ভালো পাওয়া যাচ্ছে, ফলে সহজে লাভবান হওয়ার চিন্তা থেকেই একশ্রেণির মানুষ এসব ওষুধের নকল বের করছে। নজরদারি না থাকায় বিভিন্ন মাধ্যম হয়ে ওষুধগুলো ঢাকার অলিগলির ফার্মেসি থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে।

ভোক্তাদের সংগঠন ক্যাবের ভাইস-প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘নকল ওষুধ উৎপাদনে যেহেতু আসলের (বেশি টাকা) মতো খরচ হচ্ছে না, সে কারণে ওষুধগুলো কোম্পানির চেয়ে অনেক কম দামে ফার্মেসিগুলো পেয়ে যাচ্ছে। তাই বেশি লাভের আশায় অসাধু ব্যবসায়ীরা এগুলোর সাথে জড়িত হচ্ছে।’

বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা: চঞ্চল কুমার ঘোষ বলেন, ‘আবার অনেক সময় কিছুটা কম দামে পাওয়ার আশায় রোগীরাও নকল ওষুধ কিনে প্রতারিত হচ্ছেন। বিশেষ করে যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়, তারাই দেখা যাচ্ছে এগুলো কিনছেন এবং প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।’

ফার্মেসির অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে মান

বেসরকারি তথ্য মতে, ‘বাংলাদেশে বর্তমানে আড়াই লাখেরও বেশি ওষুধের দোকান রয়েছে। এসব ফার্মেসির মধ্যে বড় একটা অংশেরই অনুমোদন নেই। আবার যেগুলোর অনুমোদন রয়েছে, নজরদারির অভাবে সেগুলোর মধ্যে অনেক ফার্মেসি নিয়ম-নীতি মানছে না বলেও জানা গেছে।

অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, ‘বিশেষ করে মফস্বল শহর ও গ্রামে যে ফার্মেসিগুলো গড়ে উঠছে, সেগুলোর বেশিরভাগই দেখা যাচ্ছে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছে না। ওষুধ সংরক্ষণের মতো ভালো পরিবেশও নেই। অথচ ওষুধ সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ধরনের পরিবেশের প্রয়োজন হয় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

তিনি বলেন, ‘ওষুধের গায়েই লেখা থাকে যে সেটি কেমন পরিবেশে এবং কত ডিগ্রি তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হবে। সেজন্য ফার্মেসিতে এসি এবং ফ্রিজ রাখাটা জরুরি। কিন্তু আমরা তো দেখছি, ঢাকার বাইরে এমনকি ঢাকার ভেতরেও অসংখ্য ফার্মেসিতে এ ধরনের ব্যবস্থা নেই। ফলে ওষুধের মানও নষ্ট হচ্ছে।

স্বাস্থ্যে কেমন প্রভাব পড়ছে?

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়াকে জাতীয় স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা: মুশতাক হোসেন বলেন, ‘টাকা খরচ করে এসব ওষুধ কিনে মানুষ কেবল প্রতারিতই হচ্ছে না। এর কারণে তাদের ভোগান্তি বাড়ছে। এমনকি অনেকে মারাও যাচ্ছেন।’

মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক ডা: শাহনূর শরমিন বলেন, ‘ভেজাল ও নকল ওষুধ দু’ভাবে মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে। এর মধ্যে কিছু তাৎক্ষণিক ক্ষতি হচ্ছে, আর কিছু হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিও হচ্ছে।’

এ বিষয় নিয়ে ডা: শরমিন আরো বলেন, ‘তাৎক্ষণিক ক্ষতিটা হলো রোগীর ভোগান্তি। আটা-ময়না দিয়ে বানানো নকল ওষুধ যেহেতু কাজ করতে পারে না, সেক্ষেত্রে রোগ সারছে না। অন্যদিকে যেগুলোতে রাসায়নিক উপাদান রয়েছে, সেগুলোর কারণে দীর্ঘ মেয়াদে রোগীর শরীরে নতুন নানান স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি হতে পারে।’

ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, আবার গুরুতর অসুস্থ রোগীর ক্ষেত্রে নকল-ভেজাল ওষুধ মৃত্যুরও কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এক্ষেত্রে ওষুধে কাজ না হওয়ায় যেমন মৃত্যু হতে পারে, তেমনিভাবে রাসায়নিক উপাদানের প্রতিক্রিয়াতেও সেটি ঘটতে পারে।’

গতবছর ঢাকার বেশকিছু হাসপাতালে অ্যানেস্থেসিয়া বা চেতনানাশক ওষুধ দেয়ার পর কমপক্ষে তিনটি শিশুর মৃত্যু হয়। পরে চেতনানাশকে ব্যবহৃত ‘হ্যালোথেন’ পরীক্ষা করে চিকিৎসকরা জানতে পারেন, সেগুলোতে ভেজাল ছিল। এ ঘটনার পর দেশের সরকারি-বেসরকারি সকল হাসপাতালে চেতনানাশক ওষুধ হিসেবে হ্যালোথেনের ব্যবহার বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

গবেষকরা জানিয়েছেন, ‘নকল ও ভেজাল ওষুধের মতো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখা না গেলেও নিম্নমানের ওষুধে দীর্ঘমেয়াদে জনস্বাস্থ্যের বড় ক্ষতি করছে।’

ড. মহিউদ্দিন আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, ‘অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রে ওষুধ যদি নিম্নমানের হয়, তাহলে সেটি কাজ তো করেই না, বরং উলটা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দীর্ঘমেয়াদে এটি শরীরে বিভিন্ন জটিলতা তৈরি করতে পারে।

সারাদেশে যেভাবে ছড়াচ্ছে নকল ওষুধ

স্বাভাবিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় নকল ও ভেজাল ওষুধের উৎপাদন এবং বিক্রি কম দেখা যায়। কিন্তু জুলাই আন্দোলনের পর থেকে পুলিশ বাহিনীকে আগের মতো সক্রিয় অবস্থায় দেখা যাচ্ছে না। ওষুধ প্রশাসনকেও আগের মতো মাঠে নামতে দেখা যায়নি।

ঢাকায় ওষুধের বড় পাইকারি বাজার মিটফোর্ড এলাকার একজন ওষুধ ব্যবসায়ী বলেন, ‘এই সুযোগে তারা আবারো ব্যবসা শুরু করছে।’

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যবসায়ী বলেন, ঢাকা ও এর আশপাশের কিছু এলাকায় নতুন করে নকল ওষুধ উৎপাদন শুরু হয়েছে। কেরানীগঞ্জ, কামরাঙ্গীর চর ওইসব এলাকায় কারখানা আছে শুনছি। তবে ঠিক কারা এসব নকল ওষুধের উৎপাদন ও বিক্রির সাথে জড়িত, সে বিষয়ে মিটফোর্ড এলাকার ওষুধ বিক্রেতাদের কেউ মুখ খুলতে রাজি হননি।

বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতি কার্যালয়ের সচিব আবু হেলা মোস্তফা কামাল বলেন, যদিও মিটফোর্ডের ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধেও নকল ওষুধ বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। এমনকি নকল ওষুধ বিক্রির অভিযোগে ওই এলাকার ব্যবসায়ী নেতাদেরও গ্রেফতার হওয়ার নজির আছে। কিন্তু এখন যতটুকু জানি, এগুলো অনেক কমে গেছে। তারপরও কেউ নকল ওষুধ বিক্রি করছে কিনা, সেটা বোঝা মুশকিল। ধরা না পড়া পর্যন্ত বুঝা যায় না।

ব্যবসায়ীরা বলেন, ‘নকল ওষুধ বিক্রির ধরন এখন বদলে গেছে। আগে দেখা যেত সরাসরি মার্কেটে দিত। কিন্তু এখন বিক্রি করে অনলাইনে। আবার কুরিয়ার করেও পাঠায়। এভাবে সারাদেশে ছড়াচ্ছে।’

অতীতে নকল ও ভেজাল ওষুধ কারকারিদের যারা গ্রেফতার হয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই ধরা পড়েছেন গোয়েন্দা পুলিশের হাতে।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ওয়ারি বিভাগের উপকমিশনার মোস্তাক সর্দার বলেন, ‘আসলে নতুন চক্রটির ব্যাপারে এখনো কোনো তথ্য আমার জানা নেই। তবে বিষয়টি অবশ্যই খতিয়ে দেখব।’

বন্ধ হচ্ছে না কেন?

ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধের বিরুদ্ধে বছরের পর বছর ধরে অভিযান চালাচ্ছেন ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। কিন্তু তারপরও কেন নকল ও ভেজাল ওষুধের উৎপাদন এবং বিক্রি বন্ধ হচ্ছে না?

এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘এক কথায় বললে, আইনের কঠোর প্রয়োগ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাব তা বন্ধ হচ্ছে না।

ক্যাবের নেতা এস এম নাজের হোসাইন এ বিষয়ে বলেন, ২০২৩ সালে পাস হওয়া ওষুধ ও কসমেটিক আইনে নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রির সাথে জড়িত ব্যক্তির যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। গত দুই বছরে নকল ওষুধ কারবারিদের মধ্যে কয়েকজন ধরাও পড়েছে। কিন্তু কাউকেই যাবজ্জীবন সাজা দিতে দেখা যায়নি। উল্টো দেখা যাচ্ছে, যারা ধরা পড়ছেন তারাও কয়েক মাসের মধ্যে ছাড়া পেয়ে পুনরায় ব্যবসা শুরু করেছে। কারণ তারা দেখেছে, শাস্তি হয় না।

এদিকে নকল ওষুধ ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে ওষুধ প্রশাসনেরও নজরদারির ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা তা অস্বীকার করছেন।

ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক আসরাফ হোসেন বলেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। প্রতি মাসেই কোথাও না কোথাও আমরা অভিযান পরিচালনা করছি। সম্প্রতি বাজারে ভেজাল ও নকল ওষুধ বেড়ে যাওয়ার যে খবর পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলোর বিষয়েও তথ্য নেই ওষুধ প্রশাসনের কাছে। কারো জানা থাকলে তারা যদি আমাদের জানায়, অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

নকল ও ভেজাল ওষুধের মামলায় সাজা না হওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এটা আদালতের ব্যাপার, আমাদের হাতে নেই।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তদন্তে গাফিলতি থাকার কারণে অনেক সময় দোষী ব্যক্তিকে শাস্তি দেয়া যাচ্ছে না।

উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে দেশের একটি কোম্পানির প্যারাসিটামল সিরাপ পান করে কমপক্ষে ২৮টি শিশুর মৃত্যু হয়।

এ ঘটনার পর ওই কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। কিন্তু তদন্তের সময় আদালতে প্যারাসিটামল সিরাপের যে নমুনা জমা দেয়া হয়েছিল, তা সরাসরি ওই কারখানা থেকে জব্দ না করায় কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সে সময় সরকারি আইনজীবীদের কথায় তদন্তের সেই দুর্বলতার কথা প্রকাশ পেয়েছিল। 

সূত্র : বিবিসি

মুল্যবান মন্তব্য করুন