প্রতিবেশী দেশ ভারতে করোনাভাইরাসের নতুন ধরনের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় দেশটির সাথে বাংলাদেশের সীমান্তের স্থল ও নৌবন্দরগুলোর পাশাপাশি সবকটি বিমানবন্দরে স্ক্রিনিং বা স্বাস্থ্য পরীক্ষা জোরদার করা হয়েছে বলে ঢাকায় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
ভারতসহ যেসব দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বেড়েছে, ওইসব দেশে ভ্রমণের ব্যাপারে সতর্কবার্তা দিয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদফতর।
প্রয়োজন ছাড়া ওইসব দেশে ভ্রমণ না করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।
এদিকে, প্রায় দেড় বছর পর আবারো বাংলাদেশে কোভিড-১৯-এ একজনের মৃত্যুর ঘটনা সামনে আসায় জনমনে নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ৮১ থেকে ৯০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
এই মৃত্যুর ঘটনা কোভিড-১৯-এর বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে সাধারণ মানুষকে।
যদিও এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই বলে অভিমত স্বাস্থ্য অধিদফতর ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের।
স্বাস্থ্য অধিদফতর স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের পরিচালক ফরহাদ হোসেন জানিয়েছেন, সাধারণত গরম গুমোট আবহাওয়ায় করোনাভাইরাস বেশি সংক্রমিত হয়। অন্যান্য বছরও মে মাস থেকেই করোনার প্রকোপ বেড়েছে, এ বছরও তাই হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে দেশে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২৩ জন। মে মাসে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৬ জনে। আর জুন মাসের প্রথম আট দিনে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৬ জন, এবং একজন মৃত্যুবরণ করেছেন।
এমন অবস্থায় সংক্রমণ ঠেকাতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ সংক্রমণ হারের ঊর্ধ্বগতি বিবেচনা করে জনসমাগমপূর্ণ এলাকায় সকলকে মাস্ক পরার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। বিশেষত বয়স্ক ও অসুস্থ ব্যক্তিদের এ ধরনের স্থান এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
এ ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়ে সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব বলে জানান ফরহাদ হোসেন। তাছাড়া যে ব্যক্তি মারা গেছেন তিনি আরো নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন বলে জানান।
এবারে করোনার নতুন কিছু ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। থাইল্যান্ড, চীনের পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও দ্রুত সংক্রমিত নতুন ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার খবর প্রকাশ হয়েছে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ আইসিডিডিআর,বি’র তথ্যমতে, চলতি বছর সংক্রমণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো করোনার নতুন দুটো সাব-ভ্যারিয়েন্ট এক্সএফজি ও এক্সএফসি। যেগুলো ওমিক্রন জেএন.১-এর একটি উপশাখা।
সম্প্রতি যেসব নমুনা পাওয়া গেছে, তার প্রায় সবগুলোতে এক্সএফজি ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ক্ষমতা বেশি। ফলে স্বাস্থ্যবিধি না মানলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে সতর্ক করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
এক্ষেত্রে তারা বয়স্ক ব্যক্তি, শারীরিকভাবে দুর্বল কিংবা আগে থেকো জটিল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যবিধি মানার পরামর্শ দিয়েছেন। কেননা তাদের জন্য এই ভ্যারিয়েন্ট মারাত্মক হতে পারে।
এদিকে, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এনবি.১.৮.১ নামে আরেকটি নতুন ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। জেনেটিক সিকুয়েন্স পরীক্ষার মাধ্যমে তা জানা গেছে।
গত ২৩ মে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক বুলেটিনে বলা হয়েছে, এই ভ্যারিয়েন্ট খুব দ্রুত ছড়াচ্ছে এবং এর সংক্রমণ হার তুলনামূলকভাবে বেশি।
ভারতের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ দেখা দিয়েছে দক্ষিণ ভারতের কেরালায়। তারপরে গুজরাট ও পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান। এই স্থানগুলোকে ‘সংক্রমণের হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আশঙ্কা করছে, এই নতুন ভ্যারিয়েন্ট ভারতের সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশেও প্রবেশ করতে পারে।
এজন্য বেনাপোলসহ সকল স্থল, নৌ ও বিমানবন্দরে স্ক্রিনিংসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মানার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ জোরদার করা হয়েছে। সন্দেহভাজন যাত্রীদের জিনগত পরীক্ষা এবং নজরদারি বাড়ানোরও নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
গত ৪ জুন স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে এক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ভারতের মতো দেশ থেকে আগত যাত্রীদের ইমিগ্রেশন ও আইএইচআর হেলথ ডেস্কের সহায়তায় স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও স্বাস্থ্য বার্তা সরবরাহ করা হবে। সেইসাথে স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিবিড়ভাবে পরিচালনা করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
ইতোমধ্যে বেনাপোল চেকপোস্ট ইমিগ্রেশনে মেডিক্যাল ডেস্কে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের ভারত থেকে ফিরে আসা যাত্রীদের করোনার উপসর্গ আছে কি না তা যাচাই-বাছাই করতে দেখা গেছে।
যদি কারো শরীরে করোনার উপসর্গ পাওয়া যায় তাহলে যেন তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আইসোলেশন করতে বলা হয়েছে।
এদিকে, ঈদের ছুটির পরে ফিরতি যাত্রায় সংক্রমণ ঝুঁকি বাড়তে পারে বলে সতর্কতা জারি করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। এক সরকারি চিঠিতে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বলা হয়েছে।
রোববার রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য অফিসার রেজাউল করিম সিদ্দিকী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়েছে, সম্প্রতি কোভিড-১৯ সংক্রমণ হারের ঊর্ধ্বগতি বিবেচনা করে জনসমাগমপূর্ণ এলাকায় সকলকে মাস্ক পরার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
বিশেষত বয়স্ক ও অসুস্থ ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ভিড়যুক্ত স্থান এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
যারা বয়স্ক, কিডনি রোগী, গর্ভবতী নারী, ক্যানসার রোগী, হাঁপানিতে ভোগেন বা অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতায় আক্রান্ত তাদের জন্য এই ভাইরাস ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা: মোশতাক হোসেন।
তিনি বলেন, কোভিডের যেকোনো ভ্যারিয়েন্টই বয়স্ক, গর্ভবতী ও আগে থেকে জটিল রোগে আক্রান্ত জনগোষ্ঠর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে আবারো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
‘আমাদের এখন থেকেই নিয়মিত হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহার, মাস্ক পরা এবং ভিড় এড়িয়ে চলা— এই অভ্যাসগুলো আবার শুরু করা প্রয়োজন,’ বলেন তিনি।
সেইসাথে হাসপাতালে যারা চিকিৎসা নিতে যাবেন বা যারা চিকিৎসা দেবেন তাদের সবাইকে মাস্ক পরা, হাত ধোয়ার মতো স্বাস্থ্যবিধি মানার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
যাদের কোভিড ১৯-এর টিকা দেয়া নেই। তাদের দ্রুত টিকা নেয়ার ওপরও জোর দিয়েছেন তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, বাংলাদেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুধু বিদেশগামী যাত্রীরাই কোভিডের টিকা নিয়ে থাকেন।
টিকাদান কর্মসূচির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে সরকারের কাছে পর্যাপ্ত টিকা মজুত থাকলেও মানুষের এই টিকা নেয়ার ব্যাপারে আগ্রহ নেই বললেই চলে।
গত ২২ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ইপিআই’র এক বৈঠকে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে টিকা নেয়ার জন্য উৎসাহিত করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
সেইসাথে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মোস্তাক হোসেন, সরকারি পর্যায় থেকে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে টিকা দেয়ার ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়ার ক্ষেত্রে জোর দিয়েছেন।
২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় এবং ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
এরপর ২০২৫ সালের ৮ জুন পর্যন্ত দেশে মোট ২০ লাখ ৫১ হাজার ৭৪২ জন আক্রান্ত হয়েছেন, মৃত্যু হয়েছে ২৯ হাজার ৫০০ জনের।
২০২৪ সালে কেউ মারা না গেলেও ২০২৩ সালে ৩৭ জন এবং ২০২২ সালে ১ হাজার ৩৬৮ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
স্বাস্থ্য অধিদফতর ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উভয়েই মনে করছে, বর্তমানে করোনার সংক্রমণ বাড়লেও তা নিয়ে এখনই আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
সচেতনতা, ব্যক্তিগত সুরক্ষা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক ফরহাদ হোসেন।
সূত্র : বিবিসি