ঢাকার রাজনীতিতে হিমেল হাওয়া

আরিফুল ইসলাম , প্রকাশ:18 এপ্রিল 2025, 12:03 রাত
news-banner

লন্ডনে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সাথে জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা: শফিকুর রহমানের স্বাক্ষাতের খবর প্রকাশের পর থেকেই ঢাকার রাজনৈতিক মহলে হিমেল হাওয়ার সৃষ্টি করেছে। দুই দলের নেতাকর্মীদের সামাজিক মাধ্যম ও সভা সেমিনারে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি বিষয়টি থেকে সরে এসে পজিটিভ বার্তা দিচ্ছে। এই সাক্ষাৎকার আগামী দিনের রাজনীতির তাপমাত্রা আরও নামিয়ে দেবে বলে মনে করছেন অনেকে।

জানা গেছে, গত রোববার যুক্তরাজ্যের লন্ডনে অবস্থানরত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করেছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা: শফিকুর রহমান ও নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। লন্ডনে খালেদা জিয়ার ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বাসায় তাঁদের এ সাক্ষাৎ হয়। এ সময় তারেক রহমানও উপস্থিত ছিলেন।

প্রায় দুই সপ্তাহের সফর শেষে গত সোমবার সকালে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান দেশে ফিরেছেন। আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এখনো দেশে ফেরেননি।

বেগম খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাতের বিষয়টি স্বীকার করে জামায়াতের আমির গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বেগম জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। আমরা একসঙ্গে অনেক দিন কাজ করেছি। উনি অসুস্থ। ওনার খোঁজখবর নেয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। বহুদিন পর আমাদের দেখা হয়েছে। আমরা ওনার জন্য দোয়া করেছি, ওনার কাছে দোয়া চেয়েছি।’

এদিকে খালেদা জিয়ার সঙ্গে জামায়াত আমিরের সাক্ষাৎ নিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসনের সাবেক প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান প্রথম ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘বেগম জিয়ার সঙ্গে জামায়াতের দুই শীর্ষ নেতার সাক্ষাতে কী কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তা জানা যায়নি। দুই ডাক্তারের (শফিকুর রহমান ও সৈয়দ আবদুল্লাহ আবু তাহের) এই সাক্ষাৎ রাজনীতির রসায়নে নতুন কোনো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে, নাকি নিছক সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়েই থাকবে, তা বুঝতে হলে আমাদের চোখ রাখতে হবে সামনের দিকে।’

মারুফ কামাল খান আরও লিখেছেন, ‘বেগম জিয়া উন্নত চিকিৎসার জন্য বিলেত যাওয়ার আগে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানও সস্ত্রীক তাঁর বাসায় গিয়ে দেখা করেছিলেন। সে সাক্ষাৎ নিয়েও বিশদ কিছু জানা যায়নি।

পরিবর্তনের বাংলাদেশে প্রতিদিন নানা সমীকরণ সামনে আসছে। শেখ হাসিনা-পরবর্তী দেশে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী কিছু ইস্যুতে দূরে দূরে থাকলেও জাতীয় নির্বাচন ইস্যুতে হঠাৎ করেই কাছাকাছি চলে আসছে। নির্বাচন নিয়ে বিপরীতমুখী অবস্থান থেকে দুই দলের এখন প্রায় একই সুর। উভয় দলের নেতারা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন নিয়ে যত বেশি সময় নেবে, তত বেশি সমস্যা তৈরি হবে। গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতন ও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে নানামুখী বিতর্ক শুরু হয়। বিশেষ করে বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি ও বাংলাদেশ জামায়াতের মধ্যে বৈপরীত্য দেখা দেয়। তবে, সম্প্রতি নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপি ও জামায়াতের দাবি একই প্রায়। বিএনপির নির্বাচন চায় ডিসেম্বর আর জামায়াত চেয়েছে, সামনের রমজানের আগে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারিতে।

নেটিজেনরা দু’দলের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকটি ইতিবাচক হিসেবে তাদের নিজস্ব পেজ ও আইডিতে শেয়ার ও পোস্ট করছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. মির্জা গালিব লিখেছেন, ‘বিএনপি ডিসেম্বারে নির্বাচন চায়, জামায়াত জানুয়ারির মধ্যে (রোজার আগে)। জামায়াত আর বিএনপি যে কিছুটা এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে - এটা খুবই ভালো। জামায়াত আর বিএনপি দেশের বড় দুইটা রাজনৈতিক দল, তাদের মধ্যে আন্ডারস্টান্ডিং থাকাটা আমাদের জাতীয় ঐক্যের জন্য অত্যন্ত জরুরি। তো, এইবার আপনারা দুই দল একসাথে বসে এই এপ্রিলের মধ্যে সংস্কারের যে প্রস্তাব দেয়া আছে তার ব্যাপারে একটা ঐকমত্যে আসেন। আমরা মে মাসের মধ্যে সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করে ফেলি। ভারত, আওয়ামী লীগ, বিচার- এগুলোর ব্যাপারে একেকদিন একেক কথা না বলে আপনারা দুই দল মিলে স্পষ্টভাবে আপনাদের অবস্থান জানান আমাদের। তারপর আমরা সবাই মিলে নির্বাচনের দিকে যাই। দয়া করে একথা বইলেন না, সব সংস্কার আপনারা নির্বাচনের পর করবেন। তাইলে জনগণের মনে হইব, আপনারা ক্ষমতা নিয়া যতটা উদগ্রীব, সুশাসন নিয়া ততটা না।’

তরিকুল হুদা নামে একজন তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার সাথে আমিরে জামায়াতের সাক্ষাৎ বিএনপির শাহাবাগপন্থীদের জন্যে এসিডের মতো কাজ করতেছে। এই নিয়া বিএনপির এক শাহাবাগী ইনফিল্ট্রেটরের দেখলাম বি"" পুরা কান্ধে উইঠা গেছে। আহ বেচারাদের কি একটা অবস্থা। এরাই মাফিয়াকালে চার দলীয় জোট থেকে জামায়াত মাইনাসের মূল নকশা বানাইছিলো। পরে নিজেরাই যখন মাইনাসের পাল্লায়, তখন কি করবে বিদিশা হইয়া গেছে। বিশেষ কইরা ডানপন্থীদের ফিলিস্তীনের পক্ষে বিশাল বিক্ষোভ আয়োজনে বিএনপির অংশগ্রহনের পরে বিএনপির শাহাবাগীরা আর তাদের মিত্র বামেরা বড় ধাক্কা খাইছে। তারা যে বিএনপিরে ডানদের কাছ থেকে দূরে সড়ানোর ভিতর দিয়ে ভারতীয় আধিপত্যের পক্ষে কাজ করতেছিলো, তা পুরা ব্যর্থ হইয়া গেল। আবারো বলি, শহীদ জিয়ার মূল আদর্শই ছিল ডানপন্থী বামপন্থী সকলদের ইসলাম বান্ধব বাংলাদেশী দেশাত্মবাদ আদর্শের ভিত্তিতে বাংলাদেশ গড়া। খালেদা জিয়া এই ডক্ট্রাইনকেই ডানের বাম আর বামের ডান কইছিলেন। অথচ এই ইসলাম্পন্থা ফ্রেন্ডলি অবস্থান থেকে এই শাহাবাগী ইনফিল্ট্রেটরেরা বিএনপিকে বামপন্থী ফ্রেন্ডলি বানাইতে গেছিলো। এখন তাদের গালে টাটায়া থাপ্পড় দিয়া রাজনীতি শিখাইলেন দেশনেত্রী। উনাকে শুকরিয়া। বিএনপি এখন যত তাড়াতাড়ি নিজেকে এই শাহাবাগীদের খপ্পর থেকে বের করবে, ততই জনগনের আরো কাছাকাছি হইতে পারবে। ততই তাদের কপালে ভারতীয় আধিপত্যের দালালির দাগ মুছে যাবে।’

লেখক ইমরুল হাসান তাঁর নিজের পেজে লিখছেন, ‘খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সাথে ডা. শফিকুর রহমানের দেখা করাটা পলিটিকাল কালচারের জায়গা থিকা একটা পজিটিভ ঘটনা! নাহিদ ইসলামদেরও এই ধরনের মিটিংয়ের ইনিশিয়েটিভ নেয়া উচিত! একটা পলিটিকাল দলের নেতা ডিজিএফআই'র সাথে বসার চাইতে, মিলিটারি চিফের বসার চাইতে বা বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সাথে বসার চাইতেও অন্য আরেকটা পলিটিকাল দলের লিডারের সাথে বসাটারে প্রায়োরিটি দিবে - এই পলিটকাল কালচার তৈরি করাটা জরুরি, ডেমোক্রেটিক এনভায়রনমেন্টের জন্য! মানে, পলিটিকাল দলগুলারে তো নিজেদের মধ্যে কথা-বার্তা বলাটারে একটা নরমাল ঘটনা বানাইতে পারতে হবে!’

সাক্ষাতের প্রভাব বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রাজনৈতিক নেতা বলেন, বিশ্বাস করুন, এই সাক্ষাতকার বলুন আর বৈঠক বলুন। এটা সবার কাছে প্রত্যাশিত ছিল পূরণ হয়েছে। এতে করে রাজনীতিতে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আসছে, সামনে আসবে। দু'দলের সামান্য যে দূরত্ব আছে তা শেষ হয়ে সম্পর্ক আরো দৃঢ় হবে।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল বলেছেন, বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া একজন মজলুম নেত্রী। তার সাথে দীর্ঘদিন আমাদের একসাথে পথচলা, রাজনীতিতে মতপার্থক্য থাকবে সেটা যেন মতবিরোধে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত সকলের।

তিন বলেন, সবাই সবার সমালোচনা করবে কিন্তু সেটা যেন কোনো সংঘাতে না যায়। এটা জামায়াত এবং দেশের মানুষ আশা করে। আমরা যেন একে উপরের মাঝে রাজনৈতিক শিষ্টাচারের মাধ্যমে বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে থাকি। দীর্ঘদিন পথা চলা দু’টি রাজনৈতিক দলের মাঝে অযাচিতভাবে একটি রাজনৈতিক অপর রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে এমন বক্তব্য দেয়া উচিত নয়। যা জনগণ আশা করে না। জনগণ আশা করে জুলাইয়ের গণআন্দোলনের আকাঙ্খাকে বাস্তবায়নে এক সাথে কাজ করবে।

তিনি আরো বলেন, প্রকৃতপক্ষে জামায়াত ও বিএনপির মাঝে কোনো দূরত্ব নেই। আমরা একসাথে ফ্যাসিস্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। বেগম খালেদা জিয়ার ঐতিহাসিক অবদান আছে দেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্রের জন্য। বেগম জিয়া ও তার দলের উপর স্বৈরাচার সরকার নিপিড়ন চালিয়েছে। দায়িত্বশীলতার জায়গা থেকে জামায়াতের আমির দেখা করেছেন। এটা একটা ইতিবাচক আশার দিক তৈরি করে সমর্থকদের মাঝে। জনগণের প্রত্যাশা আগামী দিনে নতুন বাংলাদেশ গঠনে দুই দল ঐতিহাসিক অবদান রাখবে। এসব সৌজন্যতা জনগণকে উজ্জীবিত করে।

বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ দুই নেতার সাক্ষাতে কী প্রভাব ফেলেছে জানতে চাইলে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল নয়া দিগন্তকে বলেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের সবচাইতে বেশি নির্যাতনের শিকার দুই দলের শীর্ষ থেকে কর্মী পর্যন্ত। সাক্ষাৎকারে বিষয়টি আমি অন্যভাবে দেখছি না। তাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক ছিল, সামনে আরো দৃঢ় হতে পারে। একসাথেই এই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম করেছি। বিএনপি ও জামায়াতের নির্বাচনের সময় বিষয়ের দাবি কাছাকাছি এটা এই সাক্ষাৎকারের একটা প্রভাব। এই সাক্ষাৎকারটি দুই দলের টপ টু বটম অর্থাৎ তৃণমূল থেকে কেন্দ্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

এ সব বিষয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, নির্বাচন ইস্যুতে জামায়াতের আমিরের বক্তব্যের পেছনে লন্ডনের বৈঠকের একটা প্রভাব তো থাকতেই পারে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে তারা গণতন্ত্রের পক্ষে ভূমিকা নেওয়ায় তাদের রাজনীতি, সংগঠন ও সংগ্রামকে দেশবাসী ইতিবাচকভাবেই নেবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, 'বিএনপি -জামায়াত ইসলামীর সাথে বহুদিনের সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্ক বিষয়টি যাতে টিকে থাকতে পারে সেজন্য হয়তো হয়তো পারে। ৫ আগস্টের পর নিজের স্বার্থের কারণে দ্বন্দ্ব ও কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি চলছিল দুই দলের মধ্যে। তবে, এই সাক্ষাত এক প্রকারের দূরত্ব ঘোচাচ্ছে বলা যায়, বিএনপি নির্বাচন দাবি করেছে ডিসেম্বরে আর জামায়াত আমির দাবি করেছেন সামনের রমজানের আগে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসে। নির্বাচন নিয়ে একই সুর দু' দলের মধ্যে। বিএনপি তারেক রহমান চালালেও দলের মধ্যে বেগম খালেদা জিয়ার ক্ষমতা বেশি রয়েছে। সে হিসেবে এই বৈঠকটি, রাজনীতিতে নয়া সমীকরণ বলা যায়। কারণ আওয়ামী লীগের পতনের পর দ্বন্দ্ব স্পষ্ট না' হলে ছিলো। ' বিএনপি - জামায়াত এক হতে চায় না' হয়তো বুঝতে পেরেছে, একা হয়ে লাভবান কেউ লাভবান হতে পারবে না, ভালো কিছু করতে পারবে না। এটি আরও পরিষ্কার বোঝা যাবে, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হলে।

"রাজনীতির এই হিমেল হাওয়া কি শুধুই একটি মৌসুমী পরিবর্তন, নাকি এটি দীর্ঘস্থায়ী শীতের সূচনা করবে – সময়ই বলবে" বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

মুল্যবান মন্তব্য করুন