নিজেদের দাবির পক্ষে জনসমর্থন আদায়ে আগামী পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে পরবর্তী দুই সপ্তাহ সারা দেশে লিফলেট বিতরণ ও বিক্ষোভ-সমাবেশ পালনেরও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
"জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়া এই অবৈধ সরকারের ক্ষমতায় থাকার কোনো অধিকার নেই," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম।
এমন একটি সময় আওয়ামী লীগ এই কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, যখন দলের শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যায়ের অধিকাংশ নেতারা হয় কারাগারে, না হয় 'পলাতক' রয়েছেন।
এমনকি দলটির সভাপতি ও ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও গত ছয় মাস ধরে ভারতে অবস্থান করছেন।
অন্যদিকে, গত পাঁচই অগাস্টের পর মামলা-হামলার ভয়ে ঘরছাড়া কর্মীরাও সবাই এলাকায় ফিরতে পারেননি। অল্প যে কয়েকজন ফিরেছেন, তারাও প্রকাশ্যে আসতে চাচ্ছেন না।
এ অবস্থায় দলটি কীভাবে হরতাল-অবরোধের মতো রাজপথের কর্মসূচি পালন করবে এবং সেক্ষেত্রে তারা কতটুকু সফল হবে, সেটি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এদিকে, আওয়ামী লীগ হরতাল-অবরোধ পালনের চেষ্টা করলে সেটি প্রতিহত করা হবে বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।
এর আগে, নূর হোসেন দিবস উপলক্ষে গত দশই নভেম্বর দলীয় কর্মসূচি ঘোষণা করেও শেষ পর্যন্ত রাস্তায় নামতে পারেনি আওয়ামী লীগ।
পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে সেদিন মাঠ দখলে রেখেছিল বিএনপি-জামায়াত এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা।
"আওয়ামী লীগ যতক্ষণ পর্যন্ত না গণহত্যা, খুন ও দুর্নীতির জন্য ক্ষমা চাইবে, এর জন্য দায়ী নেতাকর্মীদের বিচারের মুখোমুখি করবে এবং বর্তমান নেতৃত্ব ও তাদের ফ্যাসিবাদী আদর্শ থেকে আওয়ামী লীগ যতক্ষণ সরে না আসবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদেরকে কোনো বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করতে দেয়া সম্ভব না," বলেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
শীর্ষ নেতাদের একটি অংশ জেলে, বাকিরা পলাতক। এ অবস্থায় নেতৃত্বশূন্যতায় চরম দিশেহারা তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও বাড়িঘর ছেড়ে আত্মগোপনে চলে যান।
কিন্তু গত কয়েক মাসে সেই বিপর্যয় কাটিয়ে আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে দলটি।
দেশে-বিদেশে আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীদের মধ্যে ইতোমধ্যেই যোগাযোগের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে। তৃণমূলেও কেউ কেউ এলাকায়ও ফিরতে শুরু করেছেন।
অন্যদিকে, দ্রব্যমূল্য, আইনশৃঙ্খলাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের এক ধরনের হতাশা ও অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে বলে মনে করছে দলটি।
ফলে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য এই সুযোগকে কাজে লাগাতে চাচ্ছে আওয়ামী লীগ।
"দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, আইনশৃঙ্খলাসহ নানা কারণে দেশের মানুষ আজ অতিষ্ঠ। এই অবৈধ সরকারের হাত থেকে মানুষ মুক্তি চায়, বাঁচতে চায়। তাই মানুষকে রক্ষা করার জন্য, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আমরা এই কর্মসূচি দিতে বাধ্য হয়েছি," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম।
"আমাদের এই লড়াই ক্ষমতা দখলের জন্য নয়, বরং জনতার শাসন প্রতিষ্ঠা করা জন্য," বলেন মি. নাছিম।
"আওয়ামী লীগ এদেশের মানুষের দল। জনগণের স্বার্থে, জনগণের দাবি আদায়ের জন্য এই আন্দোলন কর্মসূচি। বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের নৈতিক সমর্থন রয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষরাই এই হরতাল-অবরোধ পালন করবে," বলেন মি. নাছিম।
কর্মসূচি সফল করতে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাও মাঠে থাকবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় এই নেতা।
"প্রতিটি এলাকায় আমাদের কর্মী-সমর্থকরা প্রস্তুত রয়েছেন। সাধারণ মানুষের দাবি আদায়ে তারাও মাঠে থাকবেন এবং আমরা শান্তিপূর্ণভাবে এই কর্মসূচি পালন করবো," বলেন বাহাউদ্দিন নাছিম।
কর্মসূচি পালনে বাধা দেওয়া হলে পরবর্তীতে আরও কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর মামলা-হামলার ভয়ে দেশের বেশিরভাগ এলাকার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা গা ঢাকা দিয়েছিলেন।
গত কয়েক মাসে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে আসায় তাদের কেউ কেউ এখন নিজ এলাকায় ফিরতে শুরু করেছেন।
এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের হরতাল-অবরোধের কর্মসূচিকে ঘিরে তৃণমূলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
নেতাকর্মীদের অনেকে মনে করছেন যে, নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করে তাদেরকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। যদিও তারা কেউই নাম প্রকাশ করতে চাননি।
"মামলা-হামলার ভয়ে আমরা এমনিতেই বাড়িঘরে থাকতে পারতেছি না। এর মধ্যে দলীয় কর্মসূচি পালন করতে যাওয়া মানে নিশ্চিত গ্রেফতার,
তিনি আরও বলেন, "দেশের বাইরে বসে নেতারা তো কর্মসূচি দিয়েই খালাস। তাদের তো মাঠেও নামা লাগবে না, গ্রেফতার-নির্যাতনের শিকারও হতে হবে না। যা কিছু যাবে সব আমাদের ওপর দিয়ে।"
একই সুরে কথা বলেছেন তৃণমূলের অন্য নেতারাও। পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত তারা দলীয় কোনো কর্মসূচিতেই অংশ নেবেন না বলেও জানিয়েছেন কেউ কেউ।
"কর্মসূচি দিয়েছে ভালো কথা। সিনিয়র নেতারা আগে মাঠে নামুক, তারপর আমরাও নামবো," বলেন তৃণমূলের আরেক আওয়ামী লীগ নেতা।
"আমরা আন্দোলন করে সুদিন ফিরিয়ে আনবো, এরপর গায়েবি নেতারা এসে রাজত্ব করবে, কোটি কোটি টাকা কামাবে, এবার সেটা হবে না," বলছিলেন তিনি।
তবে কর্মসূচিকে স্বাগতও জানিয়েছেন কেউ কেউ।
"এতে কর্মীদের মনোবল বাড়বে, দলও চাঙ্গা হবে," বলেন আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের এক নেতা।
প্রতিহত করবে বৈষম্যবিরোধীরা
কর্মসূচি পালনের নামে আওয়ামী লীগ মাঠে নামার চেষ্টা করলে সেটি প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।
"তারা যদি আবার এখানে এসে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা করে, কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম করার চেষ্টা করে, তাহলে এদেশের মানুষই তাদের প্রতিহত করবে," বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ।
জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের এই প্ল্যাটফর্মটি গত কয়েক মাস ধরেই বলে আসছে, শেখ হাসিনাসহ হত্যা মামলায় অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত দলটিকে তারা রাজনীতি করতে দেবেন না।
সেই অবস্থানে এখনও অনড় রয়েছেন বলে জানিয়েছেন সমন্বয়করা।
"এদেশের জনগণ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করেছে সেই পাঁচই আগস্টে। সুতরাং তারা রাস্তায় নামলে এদের মানুষই পিটিয়ে তাদের রাস্তাছাড়া করবে। এজন্য আলাদা কর্মসূচি ঘোষণার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে আমরা মনে করি না," বলেন মি. মাসুদ।
যদিও এর আগে, নূর হোসেন দিবসে আওয়ামী লীগ কর্মসূচি ঘোষণা করার পর পাল্টা কর্মসূচি দিতে দেখা গিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে।
সরকার যা বলছে
সরকারের পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছে, দল হিসেবে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা না চাওয়া এবং শেখ হাসিনাসহ হত্যা মামলায় অভিযুক্ত নেতাদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে রাজপথের রাজনীতিতে সক্রিয় হতে দেওয়া হবে না।
"বিশ্বের কোনো দেশই খুনি ও দুর্নীতিবাজদের পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসার সুযোগ দেয় না। অন্তর্বর্তী সরকারও দেশের জনগণের ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করে এবং হত্যাকারীদের নেতৃত্বে যে কোনো প্রতিবাদকে জনগণ প্রত্যাখ্যান করবে," আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় বুধবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকের অ্যাকাউন্টের একটি পোস্টে লিখেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
"আওয়ামী লীগ ও তাদের ব্যানারে অন্য কেউ অবৈধ প্রতিবাদ করতে চাইলে আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে," ওই পোস্টে লিখেছেন মি. আলম।
তিনি দাবি করেছেন, শপথ গ্রহণের পর অন্তর্বর্তী সরকার ন্যায়সঙ্গত কোনো প্রতিবাদ বা বিক্ষোভে বিধি-নিষেধ আরোপ করেনি।
উল্লেখ্য, জুলাই-অগাস্টের সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনায় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে কয়েকশ' হত্যা মামলা হয়েছে। ওইসব মামলায় দলের কয়েক ডজন নেতাকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করে কারাগারেও পাঠিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
এছাড়া আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ বিদেশে অবস্থানরত ও পলাতক অর্ধশতাধিক নেতার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।