
দক্ষিণ কোরিয়ার কেন্দ্র-বামপন্থি রাজনীতিক লি জে-মিয়ং দেশটির নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন। আজ ভোরে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পরপরই তিনি দেশের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। অপ্রত্যাশিত এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সাবেক প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওলের সামরিক আইন সংক্রান্ত বিতর্কিত পদক্ষেপ এবং পরবর্তী অভিশংসনের পর।
বুধবার (৪ জুন) এক প্রতিবেদনে এ খবর দিয়েছে ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর
লি জে-মিয়ং বিরোধী ডানপন্থি প্রার্থী কিম মুন-সুকে বড় ব্যবধানে পরাজিত করেন। লি পেয়েছেন মোট ভোটের ৪৯.৪ শতাংশ, অন্যদিকে কিম পেয়েছেন ৪১.২ শতাংশ। কিমের দল অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং একটি তৃতীয় পক্ষীয় প্রার্থীর ডানপন্থী ভোট ভাঙার কারণে সংকটে পড়ে।
সাধারণত দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর দীর্ঘ একটি ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় থাকে। তবে ইউন সুক ইওলের অভিশংসনের ফলে এই নির্বাচন অল্প সময়ের মধ্যে হওয়ায় নতুন প্রেসিডেন্টের শাসনকাল সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়।
জাতীয় নির্বাচন কমিশনের চেয়ারম্যান রোহ তে-আক আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন, ডেমোক্রেটিক পার্টির লি জে-মিয়ং-কে আমরা দক্ষিণ কোরিয়ার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করছি।
এর আগে রাতেই কিম মুন-সু ফলাফল আসার আগেই পরাজয় স্বীকার করে নেন।
সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ
লি জে-মিয়ং ক্ষমতা গ্রহণ করছেন এমন এক সময়ে, যখন দক্ষিণ কোরিয়া একাধিক সংকট মোকাবিলা করছে—অর্থনৈতিক স্থবিরতা, বৈশ্বিক বাণিজ্য যুদ্ধ এবং পরমাণু অস্ত্রধারী উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতা নিয়ে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ। এছাড়া সদ্য বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ইউনের মার্শাল ল ঘোষণার ফলে দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো বড় ধাক্কা খেয়েছে।
লি তার বিজয়ী বক্তৃতায় বলেন, এই মুহূর্ত থেকে আমাদের নতুন যাত্রা শুরু। যারা আমাকে ভোট দেননি, তারাও এই দেশের নাগরিক—আমরা সবাই মিলে সামনে এগিয়ে যাব।
তিনি উত্তরের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও যৌথ সমৃদ্ধির জন্য সংলাপ ও সহযোগিতার আহ্বান জানান।
সামরিক থেকে শুরু, ঐতিহ্য মেনে পরের পদক্ষেপ
লি তার প্রথম দিন শুরু করেছেন সেনাবাহিনীর প্রধান কমান্ডারের কাছ থেকে একটি ঐতিহ্যবাহী ফোন ব্রিফিং দিয়ে, যার মাধ্যমে দেশের অপারেশনাল নিয়ন্ত্রণ আনুষ্ঠানিকভাবে তার হাতে হস্তান্তর হয়। এরপর তিনি জাতীয় সমাধিক্ষেত্রে যান—একটি রেওয়াজ যা পূর্বসূরীরাও মেনে চলেছেন, এমনকি ইউন সুক ইওলও।
শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান ছিল অনাড়ম্বর, মাত্র কয়েকশ অতিথি উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় পরিষদ ভবনে—সেই জায়গাতেই ইউন সুক ইওল একসময় সেনা মোতায়েন করেছিলেন মার্শাল ল জারির রাতে।
লি তার দিন শেষ করেন প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি রাষ্ট্রপতির চিফ অব স্টাফ এবং জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান নিয়োগের কাজ শুরু করে। বিশেষ নজর থাকবে তিনি প্রেসিডেন্সি কার্যালয় কোথায় স্থাপন করেন—কারণ ইউন সুক ইওল ঐতিহ্যবাহী ব্লু হাউস থেকে অফিস সরিয়ে ইয়ংসানে একটি সরকারি ভবনে নিয়ে গিয়েছিলেন, যেটিকে লি এর আগে 'হঠকারী' সিদ্ধান্ত বলে অভিহিত করেছিলেন।
বৈদেশিক নীতি ও আন্তর্জাতিক বার্তা
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প লিকে ফোন করে শুভেচ্ছা জানানোর কথা রয়েছে। মার্কো রুবিও, যিনি এখন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, তাৎক্ষণিকভাবে এক বিবৃতিতে বলেন, সিউল-ওয়াশিংটনের সম্পর্ক লোহার মতো মজবুত এবং এই সম্পর্ক অর্থনৈতিক ও কৌশলগত উভয় দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ।
লি যদিও আগেও যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখার পক্ষে ছিলেন, বিশেষজ্ঞদের মতে, এবার তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করার পাশাপাশি চীন ও উত্তর কোরিয়ার সঙ্গেও কৌশলগত যোগাযোগ রক্ষা করতে চাইবেন।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানী গি-উক শিন বলেন, "লি এমন একটি কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে চাইবেন যা পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট ইউনের একমুখী নীতির থেকে আলাদা।"
দক্ষিণ কোরিয়ার গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণ?
বহু তরুণ ভোটারের মতো ২০ বছর বয়সী নোহ মিন-ইয়ং, যিনি ইউন সুক ইওলের মার্শাল ল বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন, বলেন, এখন স্বস্তি লাগছে। ফলাফল নিয়ে আর অনিশ্চয়তা নেই। যে ব্যবধানে জিতেছে, তাতে গণতন্ত্র রক্ষার প্রক্রিয়া জোরদার করা যাবে।
তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, লির বিজয় যতটা না তার জনপ্রিয়তার ফল, তার চেয়ে বেশি প্রতিদ্বন্দ্বীদের দুর্বলতা ও বিভক্তির সুযোগ। এই পরিস্থিতিতে লির সামনের দিনগুলো তার দক্ষতা ও সমঝোতার ওপর নির্ভর করবে—বিশেষ করে যখন দেশ গণতন্ত্র পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।