
আর এটাই ছিল ‘ডিঙি’-এর বিশেষত্ব। দক্ষিণ উপকূলের জেলেরা অগভীর সমুদ্রে ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছ ধরতে এই বিশেষ ধরনের নৌকা ব্যবহার করতেন। তবে কালের নিয়মে বৈঠার বিপরীতে সেই ডিঙিতে ইঞ্জিন উঠেছে। বৈঠা সংযুক্ত ‘ডিঙি’ অতলে তলিয়েছে।
দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাছে বিশালাকার পণ্যবাহী ‘গয়না নৌকা’ অচেনা নয়। কিন্তু সড়কপথের প্রসার ও নাব্য হারানো নৌপথ সংকুচিত হয়েছে। একইসঙ্গে বিশাল, পেটমোটা, কিছুটা চালকুমড়ো ধাচের এই কাঠের নৌকার যাতায়াত হারিয়েছে। এখন আর ‘গয়না’ তৈরি হয় না।
আর নতুন করে ‘গয়না’ তৈরি না হওয়ার কারণে হারাতে বসেছে শতাব্দী প্রাচীন নৌকা তৈরির শিল্পও। হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির অন্যতম বর্ণিল অনুষঙ্গ নৌকা।
অবলুপ্তির পথ থেকে প্রাচীন এই শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নিয়েছিল সাগরতীরে বরগুনার মানুষ। হারাতে বসা নৌকাকে প্রজন্মের কাছে বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগ নিয়েছিল বরগুনার তৎকালীন জেলা প্রশাসক। তারই অংশ হিসেবে দেশের দক্ষিণ উপকূলের শেষ জেলা বরগুনায় দেশের প্রথম নৌকা জাদুঘর স্থাপন করেছিলেন।
হারিয়ে যাওয়া ১০০ নৌকা জাদুঘরে স্থান করে নিয়েছিল। নৌকার আদলে নকশা করা এই জাদুঘরের নাম রাখা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু নৌকা জাদুঘর’। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ১৬৫ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৩০ ফুট প্রস্থের নৌকার আদলে জাদুঘরটি উদ্বোধন করা হয়।
এই নামের কারণেই হাসিনা সরকারের পতনের দিন বিক্ষুব্ধ জনতা জাদুঘরে থাকা নৌকাগুলো ধ্বংস করে। পরবর্তীতে নৌকা জাদুঘর অপসারণ করে জুলাই বিপ্লব জাদুঘর স্থাপনের দাবি ওঠে। তারই অংশ হিসেবে জেলা ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম রাকিব গতবছরের ৯ ডিসেম্বর বরগুনা জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন। তখন জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। তাই বিষয়টি এতদিন আলোচনা আসেনি।
রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেন, ‘হাসিনা সরকার দেশের জনগণের টাকা অপচয় করে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় ফ্যাসিস্ট হাসিনার রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয়ের প্রতি অনুপ্রাণিত হয়ে তৎকালীন জেলা প্রশাসক নৌকা জাদুঘর তৈরি করে। জাদুঘর ফ্যাসিবাদের নির্দেশনা হিসেবে বিবেচিত। ফ্যাসিস্ট হাসিনার নির্দেশনা নৌকা জাদুঘরের অপসারণ করে ওই জায়গায় জুলাই বিপ্লব শহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন রেখে স্মৃতি জাদুঘর স্থাপনের বিষয়টি আবেদনে উল্লেখ করেন।’
গতকাল শনিবার (১ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১১টায় জেলা প্রশাসক কার্যালয় সংলগ্ন উত্তর গেটে অবস্থিত নৌকা জাদুঘরটি গ্যাস এবং কাটার দিয়ে কেটে ফেলেছে বিক্ষিপ্ত জনতা।
এ নিয়ে জাদুঘরের অন্যতম উদ্যোক্তা পরিবেশকর্মী আরিফুর রহমান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরাসরি প্রচার করেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি লাইভে এসে বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন প্রান্ত গিয়ে নৌকার নকশা সংগ্রহ করেছি। সেই থেকে ছোট ছোট নৌকা কারিগরের মাধ্যমে তৈরি করেছি। তিনি আরো বলেন, জাদুঘরের নাম নিয়ে অনেকের আপত্তি থাকতে পারে। তার মানে এই নয় যে নৌকাগুলো ধ্বংস করবেন। থেকে নৌকা কিছু সময় ভিডিও প্রচারের পর কতিপয় ব্যক্তি এসে তাতে বাধা দেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন জেলায় ভিন্ন নামে ভিন্ন ডিজাইনে নৌকার প্রচলন আছে। কিন্তু এরই মধ্যে অনেক নৌকা হারিয়ে গেছে, অনেক নৌকা হারানোর পথে। তাই বর্তমান প্রজন্মের কাছে চিরায়ত বাংলার ঐতিহ্য নৌকাকে বাঁচিয়ে রাখতে ঐতিহ্যবাহী নৌকার রেপ্লিকা সংরক্ষণের মাধ্যমে নৌকার জাদুঘর নির্মাণে সহযোগিতা করেছিলাম। জাদুঘরে ছিল নৌকার ইতিহাস-ঐতিহ্য। এটি দেশের একমাত্র নৌকা জাদুঘরই নয়, এখানে নৌকার দাঁড়, পাল ইত্যাদির পর্যায়ক্রমে সংগ্রহের অভিযান অব্যাহত ছিল।’
তবে স্থানীয়রা বলছেন, পতিত সরকার প্রধান শেখ হাসিনাকে খুশি করার জন্য তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ নৌকা জাদুঘরটি নির্মাণ করেছিলেন। এটা নির্মাণের জন্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে গণহারে চাঁদা নিয়েছিলেন। এমনকি জেলার সকল সরকারি চাকরিজীবীদের কাছ থেকে একদিনের বেতন নিয়েছিলেন। চাঁদাবাজি করে ও আওয়ামী লীগের দালালি করে নৌকা জাদুঘরটি করেছিল সাবেক জেলা প্রশাসক। এজন্যই বিক্ষিপ্ত জনতা আজ নৌকা জাদুঘরটি ধ্বংস করা হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শফিউল আলম মুঠোফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পৌরসভার ওই জমিতে একটা সময় গণগ্রন্থাগার ছিল। সেখানেই ব্যক্তিগত অর্থে জাদুঘরটি করা হয়েছিল। ৫ আগস্ট ভেতরের নৌকাগুলো বিক্ষুব্ধ জনতা ধ্বংস করেছিল। তখন থেকেই সেটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল। পরবর্তীতে জাদুঘরটি অপসারণ করে ওই জায়গায় জুলাই বিপ্লব শহীদদের স্মৃতি জাদুঘর স্থাপনের জন্য আমার কাছে আবেদন এসেছিল। পরিত্যক্ত জাদুঘরটি শনিবার কে বা কারা অপসারণ শুরু করেছে তা আমি জানি না।’