
নিজস্ব প্রতিবেদক :
পবিত্র রমজানের প্রথমদিনেই জমে উঠেছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী চকবাজারের ইফতারের বাজার। চকবাজারের বেশিরভাগ দোকানেই ইফতার কিনতে ক্রেতাদের উপছে পড়া ভিড়। তবে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে ‘বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙ্গা ভইরা লইয়া যায়’ তৈরিতে ডিম, মগজ, আলু, ঘি, কাঁচা ও শুকনো মরিচ, মাংস, সুতি কাবাব, মাংসের কিমা, ডাবলি, বুটের ডালসহ নানা রকম ইফতার।
রোববার বাজার জুড়ে ঘুরে দেখা গেছে, চকবাজার শাহী মসজিদের সামনে সার্কুলার রোডের দুই পাশজুড়ে মুখরোচক নানা পদের ইফতার সামগ্রীর পসরা সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। প্রায় ৭০ বছরের পুরনো এই ইফতার বাজার যেমন ঐতিহ্যবাহী, তেমনি সারা দেশেই রয়েছে এর সুখ্যাতি। তাই তো প্রতিবারের মতো এবারের রমজানের প্রথম দিনেই উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে এই ইফতার বাজারে।
ঐতিহ্যবাহী এই বাজারে প্রথম দিনে ইফতার কিনতে আসা মানুষের যেমন ভিড় ছিল, তেমনি শুধু দেখতে আসা মানুষের ভিড়ও কম ছিল না। বিক্রেতাদেরও ইফতার আইটেমের নাম ধরে হাঁক-ডাক দিতে দেখা গেছে। গত বছরের তুলনায় এবার চকবাজারে ইফতার আইটেমের দাম বেশি বলে জানিয়েছেন ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ে। তবে ঠিক কতখানি দাম বেড়েছে সেই ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে কেউ কিছু বলতে পারেননি। কেউ বলছেন দ্বিগুণ দাম বেড়েছে, কেউবা বলছেন ২৫ শতাংশ দাম বেড়েছে। দাম যাই বাড়ুক, খানদানি ইফতার কিনতে কার্পণ্য ছিল না ক্রেতাদের।
সরেজমিনে দেখা যায়, নবাবী শাহী হালিম ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা, ঘি ও জাফরানে ভাজা নবাবী স্পেশাল শাহী জিলাপি ৪৫০ টাকা কেজি, ঘি ও জাফরানে ভাজা নবাবী স্পেশাল বোম্বে জিলাপি ৩৫০ টাকা কেজি, ঘি ও জাফরানে ভাজা নবাবী স্পেশাল রেশমি জিলাপি ৬০০ টাকা কেজি, নবাবী জর্দা ২৫০ টাকা কেজি, নবাবী ক্ষিরসা ফালুদা ৩৫০ টাকা কেজি, নবাবী জাফরানি পেস্তা বাদাম শরবত ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা কেজি, নবাবী বোরহানি ১২০ থেকে ২৩০ টাকা বোতল, নবাবী লাবাং ১২০ টাকা লিটার, সুইট লাচ্ছি ২৫০ টাকা লিটার, চিকেন ঝাল ফ্রাই ১৪০০ টাকা কেজি, বিফ ভুনা ১ হাজার ৬০০ টাকা কেজি, মাটন ভুনা ১হাজার ৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া শাহী ছোলা ৩৫০ টাকা কেজি, পেঁয়াজু ১৫ টাকা পিস, বেগুনি ১৫ টাকা পিস, চিকেন সমুচা ৩০ টাকা পিস, ফুলকপির চপ ৩০ টাকা পিস, অনথন ৩০ টাকা পিস, মধুবান ৫০ টাকা পিস, মুরালি ৩০০ টাকা কেজি, ডিম চপ ৩০ টাকা পিস, স্প্রিং রোল ৩০ টাকা পিস, স্পেশাল বাটার নান ৭০ টাকা পিস, রুমালি রুটি ৪০ টাকা পিস, চিকেন রেশমি কাবাব ২৮০ টাকা পিস, শিক কাবাব ২২০ টাকা পিস, চিকেক সাসলিক ১৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া পানীয়ের দিক দিয়ে প্রতি লিটার শরবত-ই মোহাব্বত ২০০ টাকা, মাঠা ১৪০ টাকা, গোড ২৫০ টাকা, লাবাং ২০০ টাকা, বোরহানি ১২০ টাকা, পেস্তা বাদামের শরবত ৩৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মিষ্টি জাতীয় খাবারের মধ্যে প্রতি পিস মালপোয়া ৩০ টাকা, পাটিসাপ্টা ৩০ টাকা, ফালুদা (বক্স) ১১০-২২০ টাকা, ফিরনি (বক্স) ১২০ টাকা, জর্দা (বক্স) ১২০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা যায়।
চকবাজারে তিন প্রজন্ম ধরে ইফতার বিক্রি করে আসছেন মন্টু মিয়া। থাকেন পুরান ঢাকার বকশি বাজারে। তিনি বলেন, আমার নানা এখানে ইফতার বিক্রি করতেন। তারপর মামারা বিক্রি করতেন। এখন আমি বিক্রি করছি। ১০ বছর বয়স থেকে এখানে ইফতার বিক্রি করি। প্রায় ৩২ বছর হয়েছে। প্রতি বছরই ঐতিহ্যবাহী এই ইফতার বাজার জমে ওঠে। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। প্রথম দিনেই ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় রয়েছে। ইফতারের আগ মুহূর্তে এটি আরও বাড়বে। মো. হারুনের পরিবারও তিন প্রজন্ম ধরে এই বাজারে ইফতার বিক্রি করছেন। তিনি বলেন, এবার ইফতারের দাম প্রায় দ্বিগুণ। নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম বেশি। গ্যাস থেকে শুরু করে ধনিয়া পাতা পর্যন্ত। ইফতারের দাম না বাড়িয়ে উপায় নেই। ৫০ বছর ধরে এখানে ব্যবসা করছি। আমার আগে আমার বাবা, দাদা করতো। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ভিড় একটু কম। তারপরও হাঁটার মতো জায়গা নেই। কারণ এটি ঐতিহ্যবাহী ইফতার বাজার। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এখানে আসে। একসঙ্গে এত ইফতার আর কোথাও পাওয়া যায় না। হারুনের কথার সত্যতা পাওয়া যায় বেশ কয়েকজন ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে। রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খানদানি ইফতার কিনতে চকবাজারে ছুটে এসেছেন তারা। তাদের একজন জুয়েল। চাকরি করেন একটি ল’ চেম্বারে। তিনি এসেছেন কাকরাইল থেকে। জুয়েল বলেন, প্রতি বছরই চকবাজারে ইফতার কিনতে আসা হয়। এবার প্রথম দিনই এসেছি। কাবাব, চিকনে ঝাল ফ্রাই, চিকেগ গ্রিল, ডিম চপ, রোস্টসহ বিভিন্ন আইটেম কিনেছি। একসঙ্গে এত ইফতার দেশের আর কোথাও পাওয়া যায় না। প্রথম দিনেই এই ইফতার বাজার জমজমাট হয়ে উঠেছে।