জামায়াতের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও মননশীলতা ও চিন্তার খোরাক

, প্রকাশ:20 জুলাই 2025, 03:06 দুপুর
news-banner

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর জাতীয় সমাবেশের দিনের প্রথম অংশ ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তাদের এই অনুষ্ঠান কেবল বিনোদন ছিল না। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছিল সুনির্দিষ্ট বার্তা, চিন্তা ও মননের খোরাক। বিপুল উৎসাহ উদ্দিপনা আর বাঁধ ভাঙা উচ্ছাস নিয়ে কর্মীরা সারাদেশ থেকে অংশ নেন। সমাবেশকে পরিণত করেন স্মরণকালের বড় লোক সমাগমে। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চলা জামায়াতে ইসলামীর জাতীয় সমাবেশে মানুষের ঢল দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়েছেন কেউ কেউ।

যেমনটা লিখে স্ট্যাটাস দিয়েছেন এনসিপির শীর্ষ নেতা আব্দুল হান্নান মাসউদ। তিনি লেখেন, ‘গুদারাঘাট থেকে সকাল এগারোটায় বেরিয়েছি টিএসসিতে তরুণ লেখক ফোরামের প্রোগ্রামে জয়েন করতে। রাস্তায় কোন গাড়ি নেই, সেই হাতিরঝিল থেকে মানুষজন হাঁটছে। হাজার হাজার মানুষ, তাদের গন্তব্য একটি রাজনৈতিক দলের সমাবেশস্থল, যেটার দূরত্ব প্রায় আট কি.মি.। এখন আছি পল্টন মোড়ে, গাড়ি আর সামনে এগুচ্ছে না। ১৬ বছর ধরে যাদের ন্যূনতম রাজনৈতিক স্পেস দেয়া হয়নি, তাদের এমন সমাবেশ সত্যিই অবিশ্বাস্য। হান্নান মাসউদ লেখেন, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই সমাবেশটি হয়তো একটি মীথ হয়ে থাকবে।

গতকাল শনিবার সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে জাতীয় সমাবেশের প্রথম পর্ব শুরু হয়। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ইসলামী সংগীতশিল্পী ও গীতিকার সাইফুল্লাহ মানসুর। এই পর্বে সাইমুম শিল্পী গোষ্ঠী সংগীত পরিবেশন করে। এছাড়া বিভিন্ন মহানগর ও বিভাগীয় পর্যায়ে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো অনুষ্ঠান পরিবেশন করে। গানে গানে স্মরণ করা হয় শহীদদের। জারি গানে জানানো হয় জামায়াতের ৭ দফা।

গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতি, ছাত্র আন্দোলন ও স্লোগান নিয়ে নাটক মঞ্চায়ন করা হয়। শেখ হাসিনার পলায়ন দৃশ্যও নাটকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বিগত নির্বাচনের নানা অনিয়ম, সংঘাত আর বঞ্চনার চিত্র উঠে আসে নাট্যাংশ, আবৃত্তি ও গানের মধ্য দিয়ে। সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় ব্যবহৃত হয় দলীয় ভাবনাভিত্তিক সাহিত্যচিত্র। যেখানে ফুটিয়ে তোলা হয় জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। একটি গান উঠে আসে ভোরের আকাশ ভেদ করে- ছিন্ন ভোটের স্বপ্নগুলো, ফিরে পেতে চাই আবার, দাঁড়িপাল্লা হাতেই নেব, ইনসাফ করবো এবার। কুরআন তেলাওয়াত দিয়ে শুরু হয় প্রথম পর্ব।

সমাবেশে আগতরা পরিবেশনাগুলোকে স্বাগত জানান স্লোগান আর করতালির মাধ্যমে। অনেকের চোখে দেখা যায় আবেগ। কেউ কেউ স্মরণ করেন অতীতের হারানো গণতন্ত্রের দিনগুলো। সংগঠকরা জানান, এ ধরনের পরিবেশনার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জনতার সঙ্গে গভীর সংযোগ তৈরি এবং রাজনৈতিক বার্তা আরও গভীরভাবে উপস্থাপন। এতে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে “ন্যায় ও ইনসাফ”। দলীয় প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’র মাধ্যমে যা প্রতিফলিত হচ্ছে।

নির্বাচনের ইতিহাস ঘিরে তৈরি এসব সাংস্কৃতিক উপস্থাপনাগুলো যেন একটি নীরব প্রতিবাদ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, বঞ্চনার বিরুদ্ধে। পাশাপাশি এটিও একটি আহ্বান-জনগণের কাছে, যেন তারা আগামী নির্বাচনে চিন্তা করে ভোট দেন, দেন সত্য ও ইনসাফের পক্ষে।

বলা হয় সমাবেশে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য শুরুর আগে সাংস্কৃতিক পরিবেশনাগুলো একদিকে যেমন অংশগ্রহণকারীদের উজ্জীবিত করে, অন্যদিকে তৈরি করে একটি চিন্তাশীল আবহ। যা রাজনৈতিক কর্মসূচিকে দিচ্ছে ব্যতিক্রমী রূপ। অনেককেই বলতে দেখা যায়, রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামি সংগীত-দেশাত্মবোধক ও জুলাই আন্দোলনের গানে মুখর হয়ে উঠে জামায়াত ইসলামীর সমাবেশ। মাইকে ভেসে আসে ইসলামি ভাবধারার গান, দেশাত্মবোধক গান, রাজশাহী অঞ্চলে ভাওয়াইয়া ও বিভিন্ন স্লোগান। সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় অংশ নেয় সাইমুম শিল্পী গোষ্ঠী, মহানগর শিল্পী গোষ্ঠীসহ দেশের বিভিন্ন ইসলামি গান ও নাটকের শিল্পী গোষ্ঠী।

সমাবেশস্থলে অংশ নিতে আসা নেতাকর্মীরা তাল মেলান সেই গানের সঙ্গে। কেউ গলায় জাতীয় পতাকা জড়িয়ে, কেউ দলের পতাকা হাতে তাকবির ধ্বনি দেন।

এদিকে ব্যাপক উদ্দিপনা দেখা গেছে সমাবেশে আগতদের। গতকাল ভোর থেকে নেতাকর্মী ঢাকার বিভিন্ন প্রবেশমুখ দিয়ে সমাবেশস্থলে আসেন। দুপুরেও ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খ- খ- মিছিল নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নেতাকর্মীদের আসতে দেখা গেছে। রাজধানীজুড়ে রয়েছে দলটির নেতাকর্মীদের ছোট ছোট মিছিল।

খ--খ- মিছিল, গন্তব্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যান : মিছিলে নেতাকর্মীদের বিভিন্ন ব্যানার, ফেস্টুন, পতাকা হাতে দেখা গেছে। স্লোগান দিতে দিতে তারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন, বাংলামোটর, সায়েন্সল্যাব, নীলক্ষেত এলাকায় এমন খ- খ- মিছিল দেখা গেছে। পল্টন মোড়ে জামায়াতের সমর্থক জসীম মিয়া বলেন, আমরা ময়মনসিংহ থেকে এসেছি। ট্রেনে করে ঢাকায় আসছি। অনেকদিন পর সমাবেশ তাই বাড়তি আনন্দ কাজ করছে। সমাবেশে আসা বেশিরভাগ নেতাকর্মীদের হাতে ব্যাগ, পানির বোতল, শুকনা খাবার সংগ্রহে রাখতে দেখা গেছে।

ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প : সমাবেশ ঘিরে আগত নেতাকর্মীদের চিকিৎসা দিতে স্থাপন করা হয় ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প। ১৫টি ক্যাম্পের মাধ্যমে প্রাথমিক চিকিৎসা ও জরুরি প্রয়োজনে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা নেতাকর্মীদেরকে ফ্রি চিকিৎসা দেয় ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরাম (এনডিএফ)। মেডিকেল বুথে থাকা কর্মীরা জানান, অতিরিক্ত গরম পড়ছে। এ গরমে যে কেউ অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ এসেছে। তাদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার জন্য আমরা এই ক্যাম্প করেছি। সাধারণত প্রাথমিক চিকিৎসাগুলো আমরা দিয়ে থাকি। অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে বলে জানান তারা। প্রাথমিক চিকিৎসা সেবাদানকারীরা জানান, সম্পূর্ণ সমাবেশ ঘিরে ১৫টি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এগুলোতে সাধারণত প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ওষুধ, স্যালাইন ও পানি দেওয়া হয়। প্রতি ক্যাম্পে ১০ থেকে ১৫ জন কর্মী রাখা হয়। এছাড়াও জরুরি প্রয়োজনে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস রাখা হয়।

রমনা পার্কে যা দেখা গেল : এদিকে, সোহরাওয়ার্দি উদ্যান ভরে যায় আগের রাতেই। সকাল বেলা যারা সমাবেশস্থলে এসেছিলেন তারা আর সেদিকে যেতে পারেননি। বাধ্য হয়েই বাইরে অবস্থান করতে হয়। দুপুরের দিকে রাজধানীর রমনা পার্কে অবস্থান নেন অনেকে। প্রচন্ড গরমের মধ্যে গাছের ছায়ায় আড্ডা দেন আবার কেউবা ভ্যাপসা গরমের মাঝেও শুয়ে বিশ্রাম নেন।

রমনা পার্কে অবস্থান করা বেশ কয়েকজন জামায়াত কর্মী জানিয়েছেন ভ্যাপসা গরম ও ভিড়ের কারণে পার্কে তারা অবস্থান নিয়েছেন।

রংপুর জেলা থেকে আসা জামায়াত কর্মী ষাটোর্ধ্ব আমজাদ হাসান বলেন, ভোর ৫টায় ঢাকায় পৌঁছেছি। সকাল থেকে উদ্যানে ছিলাম। গরমে দুর্বল হয়ে গেছি। খাওয়া দাওয়া করে আবার ঢুকবো সমাবেশস্থলে।

বিজয় সরণী সিগনালের আগ থেকে তীব্র যানজট। আর রাস্তার দুপাশ ধরে দলীয় টি-শার্ট গায়ে দিয়ে সমাবেশের দিকে হেঁটে যান নেতাকর্মীরা। বিভিন্ন ছোট ছোট দল দলীয় স্লোগানও দেন। ‘আমিরে জামায়াতের সালাম নিন, জাতীয় সমাবেশ যোগ দিন’, ‘নারে তাকবীরে, আল্লাহ আকবার’, ‘আজকের সমাবেশ, যোগ দিন সফল করুন’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে দেখা যায়। ঢাকার পাশের এলাকা ধামরাই থেকে আসা একজন জামায়াতের কর্মী জানান, তাদের রিজার্ভ করা বাস ছিল। কিন্তু যানজটের কারণে দেরি হওয়ায় হেঁটেই সমাবেশের দিকে যাচ্ছেন তারা। একই কথা বলেছেন গাজিপুর থেকে আসা আরও একজন কর্মী।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, জাতীয় সংসদ ভবনের সামনের সড়ক ও কারওয়ানবাজার থেকে শাহবাগ মোড় পর্যন্ত যানজট ছিল। ফলে হেটে হেটেই সমাবেশস্থলে যান নেতাকর্মীরা। এ ছাড়াও, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত যানজটের সৃষ্টি হয়। যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা জুলিয়ানা ফেরদৌস দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, এলাকায় তীব্র যানজটের কারণে তিনি তার ছেলেকে মাতুয়াইলে কোচিং সেন্টারে নিয়ে যেতে পারেননি। যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা মনিরুল হক বলেন, মহাসড়কের বেশিরভাগ যানবাহনই জামায়াতের সমাবেশে যাওয়া নেতাকর্মীদের বহনকারী বাস। সমাবেশের পথে বিপুল সংখ্যক মাইক্রোবাসও দেখা গেছে। এ ছাড়া, ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ, চিটাগাং রোড, সোনারগাঁও ও মদনপুরসহ বিভিন্ন রুটে বাসের সংকট দেখা দিয়েছে। জাতীয় সংসদ ভবনের সামনের সড়কে যানজট। ভিড়ের কারণে সমাবেশের মূল মাঠে ঢুকতে না পেরে অনেকেই শাহবাগ মোড়, রমনা পার্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বিভিন্ন সড়কে বসে পড়েন। শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বসানো ডিজিটাল পর্দায় সমাবেশ দেখছেন তাঁরা। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত রাজধানীর মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর, শাহবাগ, গুলিস্তান, নিউমার্কেট এলাকা ঘুরে জামায়াতের নেতা-কর্মীদের সরব উপস্থিতি দেখা গেছে। কারও কারও পরনে জামায়াতের লোগো সংবলিত টি-শার্ট। কারও কারও মাথায় বাঁধা দলীয় সাদা ফিতা। আবার কেউ কেউ এনেছেন দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লা।

ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় কর্মীরা : মিছিল নিয়ে স্লোগান দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশস্থলের দিকে যান কর্মীরা। ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি রাস্তার মোড়ে মোড়ে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করেন জামায়াতের স্বেচ্ছাসেবকেরা। শাহবাগ মোড়ে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণের স্বেচ্ছাসেবক রাকিবুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘শাহবাগ এলাকায় দুটি বড় হাসপাতাল রয়েছে। সেখানে রোগীদের আসা-যাওয়ায় যাতে সমস্যা না হয়, সেটি আমরা খেয়াল রাখছি। কোনো অ্যাম্বুলেন্স আসলে অগ্রাধিকার দিয়ে পার করে দিচ্ছি। আমরা ৮ হাজার নেতাকর্মী বিভিন্ন পয়েন্টে শৃঙ্খলার দায়িত্ব পালন করছি। রাস্তা চিনিয়ে দিচ্ছি পাশাপাশি যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছি। এতে করে কোনও ধরনের যানজট সৃষ্টি হচ্ছে না।

মুল্যবান মন্তব্য করুন